আন্দোলন কোন পথে

রেজাউল করিম রনি :

 

বিরোধী দলের আন্দোলন আগামীতে কোনদিকে যাবে? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই। ঈদের পরে আন্দোলন হবে-এমন কৌতুকের মধ্যে থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অনেক ঈদ পার করে দেয়। কিন্তু র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং মানবাধিকার প্রশ্নে পশ্চিমা দুনিয়ার বাংলাদেশে দৃষ্টি ফেরাবার পরে ধীরে ধীরে দলটি পুরো মাত্রায় রাজনৈতিকভাবে মাঠে ফিরে এসেছে। ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে নিজের সাংগঠনিক ও জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে জনগণের মধ্যে এক ধরনের আশা জাগানিয়া অবস্থাও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল বিরোধী দল ও তাদের মিত্ররা।

মূলত ২৮শে আক্টোবরের সমাবেশে ক্র্যাকডাউন এর পরে ডামি নির্বাচন এবং এখন আবার নেতাদের ধীরে ধীরে জামিনে বেরিয়ে আসতে থাকা ও সামনে রোজা এবং আবার ঈদের পরে আন্দোলন-সেই একই পুনরাবৃত্তির দিকে বিরোধী দলের রাজনীতিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও উঠেছে। যদিও এ মুহূর্তে বিএনপি ও সমমনা জোট আন্দোলনে মাঠে রয়েছে। ঈদের পর কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়নি।এতদিনের চলমান আন্দোলনের ব্যর্থতা ও সফলতার দিকগুলো নিয়েও রাজনৈতিক মহলে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।

সরকার ক্ষমতায় থেকে গেলেও রাজনৈতিকভাবে ডামি নির্বাচনের জোরে ক্ষমতায় এসে জনগণের দিক থেকে তারা কতোটা গ্রহণযোগ্য সেই বার্তা ইতিমধ্যেই পেয়েছে। অন্যদিকে বিপুল নেতাকর্মী আন্দোলনমুখী হয়ে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলেও প্রকৃত গণআন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ফলে বিরোধী শিবিরে এক ধরনের হতাশা ভর করা স্বাভাবিক। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখন সরকার যেকোনো কারণেই হোক বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রিতভাবে মাঠে সক্রিয় হতে দিতে রাজি। এই যে নতুন করে আবার আন্দোলনের স্পেস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এটা নিয়ে বিরোধী দল কোন ধরনের নীতি ও কৌশল নিয়ে আগাবে সেই দিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজর থাকবে।

 

বিএনপি’র নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে যে আগ্রহ ৭ই জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের আগে তৈরি হয়েছিল তাতে মাঠের নেতাকর্মী ও দলের সিনিয়র নেতাকর্মীদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনার সমন্বয়ের অভাব চোখে পড়লেও বিএনপি যে অহিংস পন্থায়, জন-জোয়ারের উপর ভর করেই সরকারকে নিজেদের দাবি মানতে বাধ্য করার লাইনে আগাবে তা স্পষ্ট ছিল। সারা দেশের সমাবেশগুলোতে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আক্রমণে অনেক বিরোধী দলের নেতাকর্মীর আহত ও কেউ কেউ মারা গেলেও বিএনপি মাঠে প্রতিরোধের বদলে জনসমর্থনে এগিয়ে থাকার কৌশল গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ফায়দার কথা চিন্তা করলে

এই কৌশল কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে এবং জনগণ পরোক্ষভাবে বিএনপি’র অবস্থানের সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে ভোট দানে বিরত থেকে আন্দোলনকে সফল হতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অবস্থার সঙ্গে দলের সব স্তরের নেতাকর্মীদের সম্মতি ছিল এমনটা বলা যাবে না। সিনিয়র নেতাদের আরও কঠোর অবস্থানে দেখতে চেয়েছিল মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন আলোচনায় এইসব বিষয় আলোচিত হতে দেখা যায়।

বিএনপি আরও কঠোর অবস্থানে গেলে আসলেই কি ভিন্ন ফল হতো? ধরে নিলাম আরও কঠোর বা প্রতিরোধের অবস্থায় যাওয়ার মতোন শক্তি দলটির আছে কিন্তু এটা কি কাজ করতো? আমাদের মনে আছে ২৮শে অক্টোবরের সমাবেশের আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত দুই দলের নেতাদের সঙ্গেই দেখা করেছেন। উভয়কে সহিংসতা এড়িয়ে শন্তিপূর্ণ পথে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে অহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সক্রিয়তা আমরা দেখেছি। কিন্তু সহিংষতাও এড়ানো যায় নাই, গণতন্ত্রের পথেও রাজনীতিকে ফেরানো যায় নাই।

তবে সমাবেশে বিএনপি ও অন্যসব সরকার বিরোধী জোট যেভাবে একযোগে ঢাকা শহরে নেমে এসেছিল তাতে বিরোধী জোট কঠোর অবস্থান বা প্রতিরোধে গেলে কি অবস্থা হতো তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রচুর প্রাণহানির অশঙ্কা তাতে থাকতো। অন্যদিকে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিরোধীদের প্রতিরোধে নেমে গেলে যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হতো তা শুধু ঢাকাতেই সীমাবন্ধ থাকতো না। সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়তো। তাতে বিরোধী পক্ষ শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতো কিনা সেই প্রশ্ন বাদ রেখেও এটা বলা যায় যে, এতে আন্দোলনের চরিত্রই পাল্টে যেতো। রাজনীতির ধরনে বিপুল পরির্বতন আসতো। কিন্তু বিরোধী দল যে এই পথে এগোনোর কোনো চেষ্টাও করে নাই তার আরও একটা কারণ আমাদের চোখে পড়ছে। আর সেটা হলো- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধরনের মার্কিন নীতির প্রতিও বিরোধী দল সমর্থন দেখাতে চেয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ও মার্কিন চাওয়ার মধ্যে একটা নীতিগত ঐক্য হয়ে যাওয়ার ফলে বিরোধী পক্ষের মনোবলে যে চাঙ্গা ভাব লক্ষ্য করা গেছে তাতে এটা চিন্তা করা মোটেও কষ্ট কল্পনা হবে না যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মার্কিন নীতিগত অবস্থানের কথাও বিরোধী জোট মাথায় রেখেই আগাতে চেয়েছে।

আন্দোলন তাই বলে সব সময় অহিংসই থেকে যায় তা না। র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট দুনিয়ার অনেক দেশেই হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসেবে যে ফরাসি বিপ্লবকে মনে করা হয় তা ছিল পুরো মাত্রায় সহিংস। কিন্তু কমিউনিজমের উত্থানের পরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সহিংসভাবে শুরু হলে পরে তা আরও একটি চরম ফ্যাসিবাদী রূপে জেগে উঠতে দেখা গেছে দুনিয়ার অনেক দেশেই। ফলে আমেরিকার এই যে নীতি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ফ্যাসিস্ট আন্দোলন ও প্রবণতা থেকে পৃথক রাখা তার প্রয়োগ আমরা করতে দেখি তথাকথিত- আরব বসন্তের সময়ে। গোটা আরব অঞ্চল জুড়ে জনতার জোয়ারে ক্ষমতার পরির্বতন হতে থাকে কিন্তু লম্বা সময় ধরে এই আন্দোলন চলে নাই এমনকি কোনো র‍্যাডিক্যাল মতাদর্শিক সংগঠন ক্ষমতার লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে পারে নাই। আমেরিকান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মডেলের একটা ব্যাপক চর্চা আমরা হতে দেখেছি আরব বসন্তে। এবং এখানে গণতান্ত্রিকভাবে আমেরিকার অপছন্দের শক্তি ক্ষমতায় চলে আসলে তখন আবার স্বৈশাসকের পাশে আমেরিকাকে দেখা গেছে। যেমনটা আমরা মিশরে দেখেছি। মতাদর্শিক সংগঠন মুসলিম ব্রাডারহুড স্বৈরাচার মোবারককে সরিয়ে গণতন্ত্রিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তাদের হঠাতে মিশরি সেনাদের কাজে লগায় আমেরিকা।

বলপ্রয়োগের রাজনীতির বিরুদ্ধে সহিংস মতাদর্শিক সংগ্রামের বিষয়ে মার্কিন ভীতির সঙ্গে ভারতের উদ্বেগও বিবেচনার বিষয়। কিন্তু বিরোধীদল আমেরিকার অহিংস পদ্ধতির পথে থাকলেও মেডেলিনের পরামর্শ মোতাবেক, ‘নানা আদর্শের একটা মিলনস্থল, যেখানে সবাই গণতন্ত্রকে আরও বেশি কার্যকর করতে চাইবে’ -এমন অবস্থা তৈরির জন্য সামাজিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচির বিস্তার ঘটাতে পারে নাই। তারা যে ৩১ দফা প্রণয়ন করেছে, সেই দাবিগুলো একটি জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই সহায়ক ও যৌক্তিক কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবন্ত তৈরি স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে জাগরূক করতে পারে নাই। গণআন্দোলন গড়ে তুলবার যে সামাজিক শর্ত- ‘সম্মিলিতভাবে নতুন স্বপ্নের দিকে ধাবিত হওয়া’-তা দেখতে পাওয়া যায় নাই। বরং আন্দোলনটা সরকারি দলের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলন (যদিও সব দলের জনগণের অনেক যৌক্তিক দাবি এতে আছে) আকারেই রয়ে গেছে।

manabzamin