১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাংবাদিক আকবর ইমাম স্বনামে অধুনালুপ্ত ‘দি টেলিগ্রাফ’ নামক ইংরেজী দৈনিকে একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট লেখেন।
ঐ রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বরাত দিয়ে একটি তথ্য প্রকাশ করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ঐ শিক্ষক জনাব আকবর ইমামকে জানান যে, ভারতের ছত্রীসেনারা ৮ই ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকায় অবতরণ করে এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এই কথা জানতে পেরে ১৪ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারতীয়রা আত্মসমর্পণের মুহূর্তটি দুদিন পিছিয়ে ধার্য করে ১৬ই ডিসেম্বর।
এই সময়ের মধ্যে, বিশেষ করে ১৪ই ডিসেম্বর তারা বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। যখন জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন তখন জেনারেল অরোরার সাথে ছিলেন ১০০ জন ভারতীয় ব্যবসায়ীর একটি ডেলিগেশন, ১৫০ জন সাংবাদিক এবং ২০০ জন আমলা। জনাব আকবর ইমাম জাসদের অদৃশ্য প্রতিষ্ঠাতা মুজিব বাহিনীর নেতা সিরাজুল আলম খানকেও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত করেছেন।
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে রাজাকার আল বদরদের কোন কার্যকারিতা ছিল না। সে সময় কারা হত্যা করেছিলো স্ব-স্ব গৃহে অবস্থানকারীদের এ নিয়ে গত ৩৩ বছর যাবত জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠতম সমর্থক বৃটেনের সাবেক মন্ত্রী জন স্টোন হাউজ এই সময়ে সশরীরে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন।
নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবার পরিজনের চাপে পরবর্তীকালে যে তদন্ত কমিশন (দেশীয়) গঠন করা হয়েছিল, এর রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। যখন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সরকারের কাছে জমা দেন তখন আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিলো। অথচ রহস্যজনক কারণে এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়া হয়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে রাজাকার আল বদরেরা যদি সত্যি সত্যিই এর জন্য দায়ী হয়ে থাকে, তাহলে তখনই তাদের বিচার করে কঠোর শাস্তি দেয়া হলো না কেন?
যুদ্ধের পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তিই তো স্বাভাবিক নিয়ম । কিন্তু কেন কোন মতাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সময় ব্যাপারটাকে রহস্যময় করে রাখা হলো? এই ব্যর্থতা কাদের? কারা এর জন্য দায়ী?
ডঃ নীলিমা ইব্রাহীমসহ কয়েকজন শেখ মুজিবকে পীড়াপীড়ি করছিল বুদ্ধিজীবীদের জন্য আলাদা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য। বিরক্ত হয়ে শেখ সাহেব বললেন, “আপা এতো বেশি মিনার বানালে এসবের পিলারে গরু বেঁধে রাখবে।”
(সূত্র : দৈনিক বাংলাবাজার, উপসম্পাদকীয় – ১৬/৩/৯৮) শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শেখ সাহেবের এই উদাসীনতা রহস্যজনক।
অথচ প্রতিবছর বিশেষ দিনগুলোতে তাদের স্মরণে রেডিও-টিভিতে নাটকের মাধ্যমে, সভা-সমিতিতে আলোচনা অনুষ্ঠান করে উদোরপিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে গত তেত্রিশ বছর যাবত নিজেরা ধোয়া তুলসি পাতা সেজে বেতালের তবলা বাজাচ্ছে। একে পুঁজি করে বিভিন্ন রংয়ের বিভিন্ন তালের, বিভিন্ন চেতনার রাজনীতি করে যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হই, যখন দেখি যাদেরকে হত্যাকারী বলে গত তেত্রিশ বছর যাবত চিহ্নিত করা হচ্ছে, তারাই এ হত্যালীলার তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের দাবি তুলছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচারের দাবি জানাচ্ছে। তবে এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জাতির সাথে আমিও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারপ্রার্থী। যে বা যারাই হত্যাকারী হোক না কেন, আমি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট সাপেক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার কামনা করি। এটাও জানি এ বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হলে অনেকেরই অনকে রংয়ের, অনকে চেতনার রাজনীতি এদেশ থেকে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। জনগণ কিছু নোংড়া ও ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিবিদদের উৎপাত থেকে জাতি রেহাই পাবে॥”
— সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ / আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল (২য় খন্ড) ॥ [বুকস ফেয়ার – মে, ২০০৪ । পৃ: ৫৬৭-৫৭০ / ৫৭৫-৫৭৭]