ভোটের ঘরের চাবিটা আর নেই

করিৎকর্মা কোনো কারিগরকে একটি বস্তুর দুটো অভিন্ন ডাইস তৈরির জন্য বলা হলো। দুটো ডাইস থেকে হুবহু একই প্রোডাক্ট বের হবে। সেটিই স্বাভাবিক, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমন বিষয়টি রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিস্থাপন করা হলে বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতির দিকে যদি নিয়ে যাওয়া হয়- তবে বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারির একেবারে সূচনায় ‘সু-সম্পন্ন’ হয়, আর ভারতের ১৮তম লোকসভার নির্বাচন, ১৯ এপ্রিল শুরু হয়েছে; শেষ হবে ১ জুন- সম্ভবত এই ছাঁচের মধ্যে পড়ে। এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বকাল অর্থাৎ এর পটভূমিকে সামনে রাখব। অর্থাৎ স্তরে স্তরে বিভিন্ন অগ্রগতি স্মরণে রাখব। সেই সাথে দৈনিক প্রথম আলোর ১৭ এপ্রিল ’২৪ তারিখের সংখ্যার পাঁচের পাতায় প্রকাশিত ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দের লেখাটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করব। আলজাজিরার জন্য লেখা নিবন্ধটি প্রথম আলো অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে। সেই নিবন্ধ পড়ে প্রথমেই লক্ষ করা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের নির্বাচনে পূর্বাপর অবাক করার মতো কিছু সাদৃশ্য। যাই হোক, অবাক করার মতো মিলগুলো নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। তবে কিছু অমিল যে দুই দেশের নির্বাচনে ছিল এটিও সত্য। অধ্যাপক মহোদয় তার লেখার সূচনায় চমৎকার হাস্যরসাত্মক কিছু উপমা-উদাহরণ ও টিপ্পনী কেটেছেন। সেগুলো এখানে পরিহার করা হলো।

অধ্যাপক অপূর্বানন্দ লেখার শুরুর দিকেই ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ‘অবশ্যই ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বৈরতন্ত্র হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যায় না, কিন্তু বর্তমানে এ দেশকে কার্যকর, স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের কাতারেও রাখা যায় না। অন্য দিকে বাংলাদেশের প্রায় সব বিরোধী দল ঠিক একই ভাব-ভাষায় বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়; বরং স্বৈরতান্ত্রিক প্রকৃতির একদলীয় ব্যবস্থার এক রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করছে। যার সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্ক খোঁজা অর্থহীন।’ আর অধ্যাপক মহোদয় তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার অনেক আগে এবং সব দলের প্রচার-প্রচারণার বাজেট বরাদ্দ দেয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বড় মাত্রায় ও রাষ্ট্র-খরচে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে। বাংলাদেশেও একইভাবে অনেক আগে থেকে মন্ত্রী বাহাদুররা রাষ্ট্রীয় যানবাহন ব্যবহার করে খালি মাঠেই নির্বাচনী প্রচার-প্রোপাগান্ডায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। এখানে খালি মাঠের কথা বলা হয়েছে। অর্থ হচ্ছে- বাংলাদেশের সব বিরোধী দলই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে বয়কট করে। ভোটের ময়দানে ছিল কেবল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদেরই ডামি প্রার্থী এবং শাসকদলের কিছু উচ্ছিষ্টভোগী আর হাতেগোনা দু-চারজন সরকারের অনুগত প্রার্থী।’

অধ্যাপক অপূর্বানন্দ লিখেছেন, ’২৪ সালের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার কিছু আগে ভোট দেখভালের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের সদস্য মনোনয়নের জন্য আইন সংশোধন করে মোদি সরকার। যাতে কমিশনে সরকারের প্রভাব বজায় রাখতে পারে। এখানে বাংলাদেশেও দেখা গেছে, বশংবদ একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়। কমিশন গঠনের একটি স্থায়ী বিধিবিধান করেছিল সরকার, তাদের চাহিদামতো করে।

অপূর্বানন্দের নিবন্ধে রয়েছে, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরপর মার্চের ২১ তারিখে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দল আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে দিল্লির দুই মন্ত্রী, দলের এক নেতাকে আটক করা হয়। বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রধান লালুপ্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে ৫ এপ্রিল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। প্রবন্ধটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এটি স্পষ্ট যে, সরকারের তদন্তকারী সংস্থাগুলো শীর্ষ বিরোধী নেতাদের কাতারবন্দী করতে বা কেবলই আইনি ঝামেলায় ফেলতে চেষ্টা করছে, যাতে তারা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে না পারে। অধ্যাপক অপূর্বানন্দ অভিযোগ করেছেন, ভারতের ক্ষমতাসীনরা অন্য দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছে। প্রতিদিন অন্য দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিজেপিতে যোগদানের খবর পাওয়া যায়। এ রকম ধারণা করা হয়, সরকারের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ভয়ভীতি ও হয়রানির ফলে তারা তাদের দল ছেড়েছেন বা ছাড়ছেন, পরে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের নিশ্চয় মনে আছে, এমন অভিন্ন ঘটনা এখানে ঘটেছে। মামলা হামলা করে বিএনপিকে নানাভাবে হেনস্তা করা, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে ঢোকানো হয়। বিএনপিকে ভেঙে ফেলার শত কৌশলও জারি ছিল। নির্বাচনের ঠিক পূর্বাহ্ণে বেছে বেছে বহু নেতাকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ানো হয়েছে। আর নির্বাচন বলতে হয়েছে অভূতপূর্ব এক প্রহসন। তবে ভারতের নির্বাচনে অন্যান্য দলের প্রার্থী ছিল, যা বাংলাদেশে একেবারেই ছিল না। ভারতের সাথে এখানে বাংলাদেশের অমিল।

অপূর্বানন্দ লিখেছেন, ‘এক মাস ধরে ভারতের ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলারের একাধিক কর-নোটিশ পাঠিয়েছে এবং জরিমানা হিসেবে দলটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৬ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করেছে। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে সীমিত প্রবেশাধিকার দিয়ে এই সংস্থা দলটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জব্দ করেছে। কংগ্রেস বলেছে, ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের এসব পদক্ষেপকে তারা দলের প্রচার-প্রচারণা ধ্বংসের একটি চেষ্টা এবং এভাবে এটি ভারতের গণতন্ত্রের ওপর একটি আঘাত হিসেবে দেখছে।’

বাংলাদেশে যেমন দেখা গেছে, প্রায় সব মিডিয়াই নির্বাচনের সময় সরকারের পক্ষে কাজ করেছে। ঠিক তেমনিই ঘটেছে ভারতে। অধ্যাপক অপূর্বানন্দ এ নিয়ে লিখেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে প্রায় সব ভারতীয় সংবাদমাধ্যম খোলাখুলিভাবে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন করেছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী অন্য মন্ত্রীদের সমর্থনে এবং তাদের নিজেদের তুলে ধরতে সংবাদমাধ্যমগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। একই সাথে সংবাদমাধ্যমগুলো এ ধরনের বক্তব্য প্রচারে উদ্যোগ নিচ্ছে, বিরোধীরা দুর্বল, প্রধানমন্ত্রী এখনো জনপ্রিয় এবং তিনি বা বিজেপির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশেও মিডিয়া বলেছে আওয়ামী লীগ যোগ্য-দক্ষ তাদের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি নেতাদের জনসম্মুখে হেয় করা অযোগ্য অদক্ষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার বহু চেষ্টাও মিডিয়া করেছে। এমন বলার চেষ্টা হয়েছে শাসকদলের কোনো বিকল্পই নেই। কোনো স্বাধীন সংবাদ সংস্থা অথবা নিউ মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যদি স্বাধীন সংবাদ সংস্থা সরকারি বয়ানের বাইরে গিয়ে কিছু বলে, সরকারের তরফ থেকে সেগুলো হামলা ও হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছে। সরকারের সমালোচক বহু জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যালেনকে নোটিশ দেয়া হয়েছে অথবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও দেখা যায় কোনো কোনো সংবাদপত্র বা সংস্থার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এখনো হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তাদের ছাড়া অন্য দলকেও সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে বারবার এবং এখনো সে প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। অপর দিকে ভারতেও অভিন্ন দৃশ্য দেখা যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসকে এই বলে আক্রমণ করেন যে, দলটির নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ‘মুসলিম লীগের’ ছাপ বহন করে। এ ছাড়া বিজেপি নেতারা সব বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে বিরোধী দলগুলোকে ‘রামবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করে তাদের নিন্দা জানায় এবং জনগণের উদ্দেশে তাদের বিরোধীদের একটি শিক্ষা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহোদয় তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন।

ভারতের এমন সর্বজনের অপ্রিয় পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও গভীরভাবে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। তারা তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভারত নিয়ে এমন উৎকণ্ঠা যে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটনা সেজন্য জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি এমন একটি বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতের জনগণের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত এবং ‘মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে’ সবাই ভোট দিতে পারে। যে পথে বর্তমানে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে, তাতে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর জাতিসঙ্ঘ এই বিবৃতি দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি বাংলাদেশের ব্যাপারে গণতন্ত্রের পথকে শুদ্ধ ও মসৃণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।

প্রবন্ধটিতে অপূর্বানন্দ লিখেছেন, ভারতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্পষ্ট, দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা জনগণের পক্ষে নয়, বিজেপির পক্ষে কাজ করবে। সংবাদমাধ্যমগুলো বর্তমান সরকারের প্রচারমাধ্যম হিসেবে ভূমিকা নিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর হাত-পা বাঁধা। পাঠক, জাতিসঙ্ঘ ভারতের ব্যাপারে যে বিবৃতি দিয়েছে- নিশ্চয় সবার স্মরণ আছে, বাংলাদেশের জন্য জাতিসঙ্ঘকে একই ধরনের বিবৃতি দিতে হয়েছিল। বলুন কী অপূর্ব মিল রয়েছে দু’দেশের গণতন্ত্রের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে। এ অভিন্নতা নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত? প্রথমে যে ‘ডাইস’ তৈরির কথা নিয়ে কথা বলা হয়েছিল; নিশ্চয়ই এ নিয়ে আর কি কিছু বলা যেতে পারে? সব কথা বলার কোনো অবকাশ এখন কি বর্তমান?

অধ্যাপক লিখেছেন, এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র ভরসা হলো ভারতীয় জনগণের, যারা নিরলসভাবে লড়াই করছেন এবং এর মূল্য খুব ভালো করেই জানেন। তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করবেন, সেটি হলো ভোট। অপর দিকে বাংলাদেশে বড় অস্ত্র ভোটটি এখন সেটি আর জনগণের হাতে নেই। ছিনতাই হয়ে গেছে। এখানে এটিও ব্যতিক্রম।

nayadiganta