অর্থনীতির সংকট কেটে যাওয়ার আভাস নেই

দেশে যে অর্থনীতির দুর্যোগ চলছে, তা কাটিয়ে ওঠার কোনো আভাস আপাতত নেই। বছরখানেকের বেশি সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ডলার সংকট থেকে উত্তরণেও নেই আশা। অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিভিন্ন সূচক এমন বার্তাই দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বর্তমান সংকটের দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে করছেন না। এমন সময়ে দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলেছে, নিকট মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকতে পারে। অব্যাহত থাকতে পারে বৈদেশিক লেনদেনের ওপর চাপ।

দেশে যে অর্থনীতির দুর্যোগ চলছে, তা কাটিয়ে ওঠার কোনো আভাস আপাতত নেই। বছরখানেকের বেশি সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ডলার সংকট থেকে উত্তরণেও নেই আশা। অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিভিন্ন সূচক এমন বার্তাই দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বর্তমান সংকটের দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে করছেন না। এমন সময়ে দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলেছে, নিকট মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকতে পারে। অব্যাহত থাকতে পারে বৈদেশিক লেনদেনের ওপর চাপ।

অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাপ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংক মনে করছে, এ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে কমে যেতে পারে। সংস্থাটির ধারণা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ সংস্থাটি গত এপ্রিলে ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ অনুমান সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। এ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও বহিঃস্থ খাত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে অর্থনীতির বেশ কয়টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতির চাপ, বহির্খাতের ওপর চাপ, টাকা-ডলার বিনিময় হারের অস্থিরতা, আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স হ্রাস, ব্যক্তি খাতের ঋণ গ্রহণ ক্রমে কমে আসার বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ঋণ বেড়ে চলা– এ রকম আরও কিছু সংকটের কথা বলা হয়।

বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার হালনাগাদ উন্নয়ন-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এতে বলা হয়, বিশ্বের যে কোনো উন্নয়নশীল কিংবা উদীয়মান অঞ্চলের চেয়ে এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের গতি বেশি থাকবে। প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে এ গতি করোনার আগের অবস্থায় ফেরার জন্য যথেষ্ট হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের হালনাগাদ উন্নয়ন’ প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত খান এবং জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বার্নার্ড জেমস হ্যাভেন। আর ‘দক্ষিণ এশিয়ার হালনাগাদ উন্নয়ন’ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রাঞ্জিস্কা ওনসর্জ। স্বাগত বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা সুদীপ মজুমদার।

ডলার সংকটই মূল ঝুঁকি

ডলার সংকটকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ঝুঁকি হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। এ সংকট ঘিরে অন্য খাতের সংকট গভীর হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা নিরসনের ওপর বহিঃস্থ খাতের স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে। বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখলে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মধ্যে দরের পার্থক্য কমবে না। টাকা-ডলার বিনিময় হার বাজারের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দিতে দেরি করলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে না। এতে পুঁজি পাচার উৎসাহিত হবে, যা বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও ঘনীভূত করে তুলবে।

অভ্যন্তরীণ কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতিরও অন্যতম বড় কারণ ডলার সংকট। মূল্যস্ফীতি শুধু আন্তর্জাতিক কারণে বাড়েনি; অভ্যন্তরীণভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার দর পতন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতির পরিস্থিতিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ১৭৯ শতাংশ হারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মতো কারণকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমার সঙ্গে দেশে সমন্বয় না করলে কিংবা বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়লে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ বজায় থাকবে বলে শঙ্কার কথা জানানো হয় প্রতিবেদনে।

আর্থিক খাতের দুর্বল পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বলা হয়, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে আর্থিক খাতের দুর্বল পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, যা ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সংঘাত বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি ঘটাবে এবং রপ্তানি আদেশ কমে যাবে।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পরামর্শ

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদোলায়ে সেক বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পথ খোলা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। বিনিময় হারে সীমা নির্ধারণ ব্যবস্থা তুলে দিয়ে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। মুদ্রানীতির আধুনিকায়ন করতে হবে এবং রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। আমানতের সুদের হার এখনও মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। ঋণ আমানতের সুদের হারও পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞ মত

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, নির্বাচনের আগে কিংবা এর পরপরই দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের কোনো আলামত দেখছেন না তিনি; বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সমকালকে তিনি বলেন, অর্থনীতির প্রায় সব খাত এখন ভঙ্গুর। কিন্তু সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। নির্বাচনের অপেক্ষায় না থেকে এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ, কাজ তো করবে আমলারা। নির্বাচনের পরে যারাই সরকারে আসুক, তারা কাজ চালিয়ে নেবে।

অর্থনীতির বিভিন্ন খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাংক নতুন কিছু বলছে না। সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর এখন এসব কথা বলছে তারা। অথচ দেশের অর্থনীতিবিদরা আরও অন্তত এক বছর আগে থেকেই এসব বিষয়ে সতর্ক করে আসছেন।

অর্থনীতির বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলের বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে ভুল নীতির কারণে অর্থনীতিতে সংকট আরও বেড়েছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত থেকেই অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি উঠে আসছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা এসব সমস্যা স্বীকার করে তা থেকে উত্তরণে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এ কারণে সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। এর পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ রেমিট্যান্স ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম বেঁধে দিচ্ছে। বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে খোলাবাজারে দাম সাত থেকে আট টাকা বেশি। প্রবাসীরা বেশি টাকার জন্য হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নানা ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতা উভয়কেই কয়েক বছর থেকে অযৌক্তিক ছাড় দেওয়া হয়েছে। মনে করা হয়েছিল, এসব ছাড় নিয়ে গ্রাহক সমস্যার সমাধান করে অর্থ ফেরত দেবে। কিন্তু তা না হয়ে ঋণদাতা ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই একই ছাড় বারবার নেওয়ার জন্য সুযোগসন্ধানী আচরণ করছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতি মাসে অন্তত ১০০ কোটি ডলার নিয়ে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। সরকার আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমালেও ডলার সংকট নিরসন হয়নি। এসব কারণে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ বাড়ার পরিবর্তে কমছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম আসছে। আবার যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার পুরোপুরি অর্থও দেশে আসছে না। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করা গেলে এ দুই খাতেই উন্নতি হওয়ার সুযোগ নেই।

সমকাল