বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় যুক্তরাজ্য, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ

deshjanata.com

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েছে দেশটি। গত বৃহস্পতিবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত দুই দেশের চতুর্থ কৌশলগত সংলাপে যুক্তরাজ্য এই অবস্থান তুলে ধরেছে।

গতকাল শুক্রবার ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ কৌশলগত সংলাপের নেতৃত্বে ছিলেন যুক্তরাজ্যের ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি ফিলিপ বার্টন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।

হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এফসিডিওর বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উঠে আসা বাংলাদেশের মানবাধিকার-সম্পর্কিত কিছু বিষয় যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব, বিধিবহির্ভূত আটক, বিধিবহির্ভূত বিচারপ্রক্রিয়া এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাজ্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া উভয় দেশই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার উন্নয়নে সুশীল সমাজের উপস্থিতি ও মতপ্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একমত হয়েছে।

ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাই কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কৌশলগত সংলাপে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্বের পাশাপাশি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে নাগরিক সমাজের উপস্থিতি ও মতপ্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে।

এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর বেশির ভাগ সময় দুই পক্ষ যৌথ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে থাকে। আর এই বিজ্ঞপ্তিতে দুই পক্ষ যে বিষয়গুলোতে একমত হয়েছে সেগুলোর পাশাপাশি দুই পক্ষের আলাদা আলাদা বিষয়ে ভিন্নমত থাকলে সেটা প্রকাশ করা হয়।

গতকাল দুপুরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। সন্ধ্যায় আলাদা আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশন।

মানবাধিকারের বিষয়ে যুক্তরাজ্য তাদের উদ্বেগ যেমন প্রকাশ করেছে। তেমনি অবাধ নির্বাচন ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে দুই পক্ষের অভিন্ন মতের বিষয়টিও যুক্তরাজ্য প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে উঠে এসেছে। যা বাংলাদেশের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি।

আলোচনায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশের এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি ফিলিপ বার্টন তাঁর দেশের নেতৃত্ব দেন।

যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সংঘাত প্রতিরোধ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, নিয়ম ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা সমর্থন সহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একে অন্যকে সহযোগিতা করতে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে।

দ্বিপক্ষীয় সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় দেশই প্রশিক্ষণ, পেশাগত সামরিক শিক্ষা ও বিনিময়সহ যৌথ সহযোগিতাকে স্বাগত জানায়। সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে এই বছরের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো প্রতিরক্ষা সংলাপ শুরুর বিষয়ে দুই পক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায়, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশকে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে যুক্তরাজ্য। আগামী বছরগুলোতে কার্বন নির্গমন হ্রাস ও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন সহ, একটি নিট জিরো টার্গেট ও কয়লা শক্তির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা জন্য বাংলাদেশের নেতৃত্বকে আরও উৎসাহিত করে।

২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। এই উত্তরণকে সফল করতে সাহায্য করতে ও বাংলাদেশ যেন তাঁদের রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, তাই যুক্তরাজ্য ২০২৯ পর্যন্ত তাঁদের দেশের বাজারে বাংলাদেশের জন্য শুল্ক ও কোটা মুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করলে উভয় দেশ তাঁদের উন্নয়ন অংশীদারত্বের ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে আলোচনায় বসবেন বলে সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতির গুরুত্ব এবং বাজার প্রবেশাধিকার বাধা হ্রাস করার ওপর যুক্তরাজ্য জোর দিয়েছে। এতে করে উভয় দেশ লাভবান হবে।

দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অভিবাসন ও সম্পর্কের গভীরতাকে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। লোকজনের অবাধ চলাচল ও অভিবাসন বিষয়ক একটি অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। যুক্তরাজ্য তাঁদের নতুন পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থায় প্রদত্ত সুযোগগুলো উল্লেখ করে। দুই দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক অংশীদারত্ব বাড়াতে বাংলাদেশকে ‘আন্ত সীমান্ত উচ্চশিক্ষা আইন’ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায় যুক্তরাজ্য ।

রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় এবং উল্লেখ করে যে, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত করবে ও বাংলাদেশে থাকাকালীন মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে সাহায্য করবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উভয় দেশ আসিয়ান ও জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যুক্তরাজ্য। বিশেষ করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরকে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাজ্যের সমন্বিত পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা এনীতিমালা পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশ একে অপরের অবস্থান নিয়ে কথা বলেছে।

আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী ও ব্রেক্সিট পরবর্তী পরিস্থিতি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন মাত্রা যোগ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে গভীরতর কৌশলগত যুক্ততার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র নীতিতে অগ্রাধিকারের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে সুযোগ তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি ফিলিপ বার্টন ব্যাপকতর দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে গণতান্ত্রিক দুই দেশের এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি গণ টিকাদানের সংখ্যা বাড়ার উল্লেখ করে মাসুদ বিন মোমেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের যুক্তরাজ্য ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। দুই দেশ সন্ত্রাসবাদ দমন, মানবাধিকার সুরক্ষা, বেসামরিক বিমান চলাচল এবং সামুদ্রিক ও অন্তর্জাল নিরাপত্তায় সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।

SHARE

Facebook