শাহ্ আব্দুল হান্নান
২০১৪ সালের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনা ছিল ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারের একটি স্কুলে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের বা তালেবানের হামলা। যার ফলে স্কুলের ১৩২ জন ছাত্রছাত্রীসহ ১৪১ জন নিহত হয়েছে। এসব ছাত্রছাত্রীর বেশির ভাগের বয়স দশ থেকে পনেরো বছর।
তালেবান এ ঘটনা কেন ঘটাল? তারা কী চায়? তারা ইসলামি শরিয়ার প্রয়োগ চায়। পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়নের পর থেকেই ইসলামি রাষ্ট্র। ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের শাসনের কথা বলা হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। সেখানে যাকাত আইন রয়েছে। সাক্ষ্য আইনে ইসলামি সাম্যের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চুরি, ডাকাতি, হত্যা- এসব ক্ষেত্রে কুরআনের বিধান হদুদ আইন জারি করা হয়েছে।
তারপর তারা আর কী চায়? যদি এসব বিধান ভালোভাবে কার্যকর না হয়ে থাকে, তাহলে তারা রাজনৈতিক দল করে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারে এবং তাদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারে, অযথা রক্তপাত না করে।
রাসূল সা. সে সময়ে যে সিস্টেম বা যে ব্যবস্থা কায়েম ছিল, তার ভেতরেই কাজ করেন। তিনি মক্কায় দাওয়াতের মাধ্যমে কাজ করেন, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। কারণ বাস্তবতার দাবি ছিল শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করা। এ কারণেই মুসলিম বিশ্বের মূল স্রোতের ইসলামি দলগুলো মধ্যমপন্থী। তারা গণতান্ত্রিক পথে তথা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সম্মতিতে পরিবর্তন চান।
হিজরতের পর মদিনায় গিয়ে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইহুদিদের সাথে চুক্তি করেন। সেই চুক্তির মাধ্যমেই ঐক্য সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্র স্থাপিত হয়। রাসূল সা.-এর ইন্তেকালের পর খেলাফতে রাশেদার সবাই নির্বাচিত হন। তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের সময় জনমত যাচাই করা হয়। জনমত যাচাইয়ে দেখা যায়, হযরত উসমান রা.-এর সমর্থন বেশি। তিনি খলিফা হন। জনমত যাচাই কেবল মদিনায় হয়। দেশব্যাপি নির্বাচন তখন বাস্তব ছিল না। এখনকার পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের সবার মতামত নিতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সিস্টেমের ভেতরে কাজ করতে হবে। যতটুকু সম্ভব, ততটুকুই করতে হবে। বাকিটুকু ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
কিছু মানুষ মুসলিম বিশ্বে শক্তির জোরে পরিবর্তন করতে চায়, রক্তপাত ঘটায়, আত্মঘাতী হামলা করে। এদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তালেবান ছাড়াও নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম, উত্তর ইরাকের খেলাফতের দাবিদার গোষ্ঠী এবং আরো কিছু গোষ্ঠী এ ধরনের রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে গোটা মুসলিম উম্মাহকে দাঁড়াতে হবে। শ্রেষ্ঠ আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে এদের বোঝানো। প্রয়োজনে তাদেরকে শক্তির মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে হবে এবং তাদেরকে নিরস্ত্র ও আটক করতে হবে। যেভাবেই হোক তাদেরকে দমন করতে হবে। এই পরিস্থিতির সুযোগে কিছু মহল মূলধারার ইসলামি দলগুলোকে, ইসলামকে অভিযুক্ত করতে পারে। তা করা অন্যায় হবে।
এ প্রসঙ্গে আমি ড. ইউসুফ আল কারজাবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘ফিকহুজ জিহাদ’ বা জিহাদের বিধানে দেয়া জিহাদ সম্পর্কিত নীতিমালা নিম্নে উল্লেখ করছি-
ড. ইউসুফ আল কারজাবির শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর একটি হচ্ছে ‘ফিকহুজ জিহাদ’ বা জিহাদের বিধান। এটি এখনও ইংরেজি বা বাংলায় অনূদিত হয়নি। তবে বইয়ের সারসংক্ষেপ ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের ওপর আরেকজন বড় ইসলামি চিন্তাবিদ তিউনিসিয়ার ড. রশিদ আল ঘানুসি ২০০৯ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করেন। এটিও ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
ড. কারজাবি জিহাদ সম্পর্কে গবেষণা করতে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেন তা নিম্নরূপ :
১. কুরআন ও সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল সুন্নাহর ওপর নির্ভর করা। দুর্বল কোনো প্রমাণ গ্রহণ না করা।
২. ইসলামের ব্যাপক ফিকাহ সাহিত্যের সাহায্য গ্রহণ করা। কোনো বিশেষ মাজহাবের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা। তারপর সবচেয়ে উপযুক্ত মত গ্রহণ।
৩. ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মের এবং আইনব্যবস্থার তুলনামূলক অধ্যয়ন করা।
৪. দাওয়া, শিক্ষাদান, রিসার্চ, ফতোয়া, সংস্কার ও পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে ‘ওয়াসতিয়া’ বা মধ্যমপন্থা গ্রহণ করা। সমকালীন সমস্যার সমাধানে ইজতিহাদকে ব্যবহার করা; যেমন পূর্বকালে সে যুগের ফকিহরা তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে করেছিলেন।
জিহাদের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জিহাদ ও কিতালের (যুদ্ধ) মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। মক্কাতেই জিহাদের আয়াত নাযিল হয়, কিন্তু তখন কিতাল ছিল না। তখন জিহাদ ছিল দাওয়ার।
ড. কারজাবি ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ইবনুল কাইয়িমকে উল্লেখ করে বলেন, কিতাল ছাড়াও জিহাদের ১৩টি পর্যায় রয়েছে। জিহাদ বিন নাফসের চারটি পর্যায়, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদের দু’টি পর্যায়, মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহাদের চারটি পর্যায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে জিহাদের তিনটি পর্যায় (হাত দ্বারা, মুখ দ্বারা এবং অন্তর দ্বারা) রয়েছে।
ড. কারজাবি আধুনিককালে পার্টি, পার্লামেন্ট, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে অত্যাচার বন্ধ করার প্রচেষ্টাকেও জিহাদ বলেছেন। তিনি নানা পদ্ধতিতে সাংস্কৃতিক জিহাদের কথাও বলেছেন (ইসলামি সেন্টার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি)।
জিহাদের লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ইসলাম আত্মরক্ষামূলক জিহাদের কথা বলেছে। যদিও আগে আক্রমণাত্মক জিহাদের পক্ষেও অনেকে বলেছেন। তিনি মনে করেন, আমাদের আগের ফকিহরা যে আক্রমণাত্মক জিহাদের কথা বলেছেন, তার ভিত্তি কুরআন বা সুন্নাহ নয়, বরং তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা। তখন সব রাষ্ট্র পরস্পর সঙ্ঘাতে লিপ্ত ছিল। কোনো সর্বস্বীকৃত আন্তর্জাতিক আইন ছিল না।
তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন : ১. সূরা তাওবায় মুশরিকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তা সাধারণ আদেশ ছিল না। সেটা ছিল আরব মুশরিকদের একটি দলের বিরুদ্ধে।
২. সামরিক জিহাদ সালাত ও সিয়ামের মতো সবার ওপর ব্যক্তিগত ফরজ নয়। ব্যক্তিগত জিহাদের কথা সূরা বাকারা, সূরা আনফাল, সূরা মুমিনুন, সূরা রাদ, সূরা লোকমান, সূরা ফুরকান বা সূরা জারিয়াতে মুত্তাকিদের গুণাবলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
৩. যদি মুসলিমরা নিরাপদ থাকে, তাহলে অমুসলিম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করা বৈধ নয়।
৪. ইসলাম ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা স্বীকার করে।
৫. ইসলাম আন্তর্জাতিক আইনের প্রণয়ন, জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানায়। মুসলিমরা আন্তর্জাতিক আইন স্বীকার করে নেয়ায় এখন অন্য কোনো রাষ্ট্রের ওপর হামলার কোনো বৈধতা নেই।
ড. কারজাবি বলেন, বর্তমান অমুসলিম বিশ্বকে দারুল আহাদ (চুক্তিবদ্ধ দেশ) মনে করতে হবে। কেননা সব দেশই এখন জাতিসঙ্ঘের আওতায় নানা চুক্তিতে আবদ্ধ।
ড. কারজাবি আরও বলেন, ইরহাব বা সন্ত্রাস আর জিহাদ এক নয়। সব ধরনের সন্ত্রাস ইসলামে নিষিদ্ধ। এর ব্যতিক্রম শুধু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা এ ধরনের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
এরপর তিনি ইসলামে জিহাদ বা যুদ্ধে যেসব নৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে, তার আলোচনা করেন।
১. যুদ্ধে অবৈধভাবে শত্রুকে প্রলোভিত করার জন্য অবৈধ পন্থা; যেমন মদ বা যৌনতা (ঝবী) ব্যবহার করা যাবে না।
২. প্রথমে আক্রমণ করা যাবে না; যেমন- কুরআনের ২:১৯০ আয়াতে বলা হয়েছে।
৩. চুক্তি রক্ষা করতে হবে।
৪. দালানকোঠা নষ্ট করা এবং গাছ ও ফসল কাটা যাবে না।
৫. আণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ; কেননা এতে যারা যোদ্ধা নন তারাও নিহত হন।
আশা করি, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জিহাদের বিভিন্ন দিক এ লেখায় সুস্পষ্ট হয়েছে।
শাহ্ আব্দুল হান্নান : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
Source: onb24.com