সরকার বিএনপিকে খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না

ফারুক ওয়াসিফ : বিএনপি ‘খুনি’ ও ‘জঙ্গি’ থেকে ‘জানোয়ারে’ উন্নীত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতারা আজকাল এসব নামেই বিএনপিকে ডেকে থাকেন। ডাকতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখা ভালো, দেশের অর্ধেক মানুষও যদি তাদের পক্ষে থাকেন, এসব গালি তাদের ওপরও বর্তায়। নিজেদের তারা মানুষ থেকে ‘জানোয়ারে’র দশায় দেখতে কতটা রাজি থাকবেন? ঘটনা হলো এই, ক্ষমতাসীনদের এত এত অভিশাপ ও গালাগালের পরও দলটি শুধু টিকেই নাই, জনসমর্থনও দেখাতে পারছে।

গল্পটা বরং উল্টা দিক থেকে পড়া যাক। ধরা যাক, বিএনপি নামক দলটি এই ধরাধামে আর নাই। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। বিরোধী দল তাহলে কে হবে? সংসদে হয়তো ক্রয়যোগ্য বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে মাঠে-ময়দানে প্রধান বিরোধী হবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এর পরে রয়েছে হেফাজতে ইসলাম– যদিও তারা এখনও নিজেদের রাজনৈতিক দল বলে ঘোষণা করেনি। এর পরে পীর-মাশায়েখদের দল– যাদের নেতার ভূমিকায় থাকবে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন। সম্মিলিত বা এককভাবে এদের যে কোনো একটিই বিএনপির অনুপস্থিতিতে বড় বিরোধী দলের ভূমিকায় চলে যাবে।

সুতরাং আওয়ামী সমর্থকেরা মনে করছেন, দেশ ভবিষ্যতে বরং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের হাতে গেলে যাক, তবু বিএনপিকে ধ্বংস করতেই হবে। বিএনপিকে ধ্বংস করতেই হবে, কেননা তারাই তো, একমাত্র তারাই তো এই সরকারকে পারলে এখনই উচ্ছেদ করতে চায়!

কোনো একটি দেশে পরপর তিনবার নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে কী হয় তার উদাহরণ ঘরের কাছের মিয়ানমার। দেশটা শুধু দরিদ্রই নয়, গৃহযুদ্ধে বিভক্ত এবং বিশ্বে একঘরে অবস্থায় রয়েছে। আমরা ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ আফ্রিকার স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর কথাও মাথায় রাখতে পারি। সেখানেও বড় বড় অবকাঠামো হয়েছে, উন্নয়নের গল্প শোনানো হয়েছে কিন্তু বালির বাঁধের মতো সব ধসে গেছে।

নজরকাড়ার বিষয় আরও আছে। আগের দুটিবার না-হয় উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে নির্বাচনী ফাঁড়া কাটানো গেছে। যেনতেন নির্বাচন করে দায় সারা হয়েছে। কিন্তু এখন যখন অর্থনীতি ধুঁকতে ধুঁকতে শুয়ে পড়ার আগের অবস্থায়, মানুষের পেটে টান, তখন উন্নয়নের বুজরুকিতে কাজ হবে? রাজনৈতিক নাবালকেরা ছাড়া উন্নয়নের গল্পে আর কারও ঘুম আসতে পারে না এখন।

এমনকি ২৮ অক্টোবরের অঘটনের পর বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল বলার গল্পটাও আর জমছে না। ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অর্থপূর্ণ নীরবতা সেই ইশারাই দেয়।

সুতরাং ক্ষমতাসীনদের সামনে আর কোনো আবডাল, আর কোনো ন্যারেটিভ, আর কোনো চাতুরীর অস্ত্র নাই। একটা অস্ত্রই এখন তারা ব্যবহার করে যাবেন– বলপ্রয়োগের অস্ত্র।

কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে বিএনপিকে একেবারে নিকেশ করাও তাদের জন্য কঠিন। একেবারে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়াটা তখন বড্ড চোখে লাগবে। সে কারণেই হয়তো বিএনপিকে ঢিলেঢালা কায়দায় আন্দোলন চালিয়ে যেতে দেওয়া হবে। অচিরেই মির্জা ফখরুলের মতো জনপ্রিয় নেতাকে জামিন দিতে হবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিকে বেঁচে থাকতে হবে। রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার অর্থ হলো আন্দোলনে থাকা। এই ঠ্যাকা সকলের: সরকারের, বিরোধী দলের এবং বিদেশিদের। কোরবানির দিনের আগে কেউ গরু কোরবানি করে না, তাকে বড়জোর বেঁধে রাখে। সুতরাং ‘বিএনপি নিজেই নির্বাচনে আসেনি’ বলার জন্য হলেও আগামী নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিএনপির তৎপরতা দেখা যাবে। দ্বিতীয়ত, নিজের খাতিরেই বিএনপিকে টিকে থাকতে হবে, এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। মাইনাস ওয়ানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারসাম্যহীন রাজনীতির খপ্পরে পড়ুক, এটা বিদেশিদের চাওয়া নয়।

সরকার যতই বলপ্রয়োগ করুক বিএনপিকে ধ্বংস করতে পারবে না। রাজনীতি ধ্বংস হয় দুইভাবে। একটা হলো মুসলিম লীগ ধরনে। হিন্দু প্রাধান্যের কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য মুসলমানদের রাজনৈতিক মঞ্চ হয়ে উঠেছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশ ভাগ হওয়ার পর মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানে আর হিন্দুরা প্রতিযোগিতার জায়গায় থাকলেন না। ফলে মুসলিম লীগের প্রাসঙ্গিকতাও থাকল না। এটা ঠিক ধ্বংস না, বলা যায় রূপান্তর। তেমন রূপান্তর হয়েছিল শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিরও। ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা শাসন করলেও পাকিস্তান আমলে দলটি প্রাসঙ্গিকতা হারায়। কারণ, কৃষক-প্রজার চাইতে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি। সে কারণে কৃষক-প্রজার অনেক লোক চলে যায় ওই মধ্যবিত্তদের দল আওয়ামী লীগে।

বিএনপির প্রাসঙ্গিকতা থাকছে কারণ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকে। দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র যতদিন না আসবে এবং নির্যাতন যতদিন চলবে ততদিন তাদের কথা মানুষ শুনবে। বিএনপি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হবে তখনই, যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের ব্যর্থতা চূড়ান্ত বলে দেখা যাবে। তখন হয়তো বিএনপিসহ আরও আরও রাজনৈতিক ধারা রূপান্তরিত হয়ে সময়ের উপযোগী অন্য কোনো দল গঠন করবে।

মানুষ শেষ পর্যন্ত স্বাধীনচেতা নৈতিক প্রাণী। চূড়ান্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়াবেই, অন্তত নীরবে ঘৃণা জানাবে। এই নীরব ঘৃণা ও চাপা প্রতিবাদ কোনো এক সময় দাবানল লাগিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা ধরে।
লেনিন বলেছিলেন, কখন পরিবর্তন হয়? যখন শাসকেরা আর আগের কায়দায় শাসন করতে পারে না এবং জনগণ যখন আর আগের মতো করে শাসিত হতে রাজি হয় না। সরকারের পক্ষে আরেকটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কিংবা নিশিব্যবস্থাপনার নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার এই নাজুক ভূরাজনৈতিক ভূমিতে অস্থিতিশীলতা টিকে থাকুক বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ুক, সেটা বিশ্বের কোনো শক্তিই চাইবে না– কারও পক্ষেই তা সুবিধার হবে না। তৃতীয়ত, দুর্নীতি ও একচেটিয়া ক্ষমতার কারণে নড়বড়ে প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশ কোনোভাবেই মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশের ভিসা পাবে না। চতুর্থ কারণের কথা প্রথমেই বলা হয়েছে। দীর্ঘকাল অগণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনো সমাজে টিকে থাকলে কী হয় তার উদাহরণ মিসর। সেনাশাসনে যখন রাজনীতি রাজপথে নিষিদ্ধ ছিল, তখন তা আশ্রয় নিয়েছিল মসজিদে। বিদেশিরাও বোঝে, তৃতীয়বারের মতো বিতর্কিত নির্বাচন মানে চতুর্থবারে ইসলামিস্টদের ক্ষমতায়ন। এ কারণেই হয়তো বাইরের চাপে মধ্যপন্থি দল হিসেবে বিএনপির জন্য টিকে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।

সরকার এবং বিএনপির অবস্থা হয়েছে সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো, ‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’। কল্পনা করুন, বিড়ালটা ইঁদুরকে দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে কিন্তু খেয়ে ফেলতে পারছে না। বিএনপিকে খেয়ে ফেললেও বিপদ, না খেলেও বিপদ। এই অবস্থারই নাম ডেডলক বা অচলাবস্থা। ইতিহাসে কোনো অচলাবস্থাই দীর্ঘকাল থাকে না। লেনিনের আরেকটা কথাও মনে পড়ছে: কখনও এক দশকেও কিছু ঘটে না, আবার এক সপ্তাহেই দশক বদলে যায়।

সমকাল