আমার স্বামীর পেট থেকে রক্ত ঝরছিল, দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই

logo

নিজস্ব প্রতিবেদক
মুদ্রিত সংস্করণ

রাজধানীর রামপুরায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় স্বামী নাদিম মিজানকে গুলি করে হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাবাসসুম আক্তার নিহা। গতকাল সোমবার (৩ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় স্বামীর হত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর পেট থেকে রক্ত ঝরছিল, দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।’ তিনি এই মামলার তিন নম্বর সাক্ষী। এ ছাড়া এ দিন চার নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন সেলুন ব্যবসায়ী মো: ইয়াকুব।

বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনালে তার এই জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যাসহ দু’জনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন নিহা।

বেলা ১১টা ২৭ মিনিটে তিন বছরের ছেলে আনাসকে কোলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন তিনি। শপথ পাঠ শেষে স্বামী হত্যার দিনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।

নিহা বলেন, আমার স্বামী শহীদ নাদিম মিজান রামপুরা বনশ্রী এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করতেন। ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার তিনি জুমার নামাজ পড়তে রামপুরা থানার সামনের মসজিদে যান। আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের দিকে স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে বাসায় নিয়ে আসে। আমি দেখি, তার পেট থেকে রক্ত ঝরছে। এই দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। পরে শুনি, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘নামাজ শেষে থানার সামনে পুলিশ ও বিজিবির ছোড়া গুলিতেই আমার স্বামী নিহত হন। লাশ বাসায় আনার পর পুলিশ তা নিয়ে যেতে চায়; কিন্তু আমরা বাধা দিই। পরে হেলিকপ্টার থেকে টিআর শেল নিক্ষেপ করা হয় আমাদের বাড়ি ও আশপাশে থাকা ছাত্রজনতার দিকে। টিআর শেলের গন্ধে আমার চোখ-মুখ জ্বলছিল।’ নিহা জানান, রাত ১০টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নাদিমের লাশ মিরপুর-১ নম্বর ঈদগাহ মাঠে নেয়া হয় এবং রাত ১১টার দিকে নামাজে জানাজা শেষে তাকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আবেগভরে তিনি আদালতে বলেন, ‘আমার স্বামীর হত্যার জন্য শেখ হাসিনা এবং যে পুলিশরা গুলি করেছে তারা দায়ী। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।’

এ দিন সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে পলাতক তিন আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেফতার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে আইনজীবী সারওয়ার জাহান তাকে জেরা করেন।

‘পুলিশের গুলি মুসার মাথায় লাগে, একই গুলি তার দাদির পেটে গিয়ে লাগে’

রাজধানীর রামপুরায় জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে দু’জন নিহতের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে চতুর্থ সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন স্থানীয় সেলুন ব্যবসায়ী মো: ইয়াকুব।

তিনি বলেন, ‘আমার নাম মো: ইয়াকুব। রামপুরা বনশ্রী এলাকায় নুসরাত হেয়ার স্টাইল নামে আমার একটি সেলুন আছে। সেই সেলুনের উপরে সাততলায় আমার বাসা। জুলাই আন্দোলনের সময় এক শুক্রবার বিকেল আনুমানিক ৩টার দিকে আমি দোকানে ছিলাম। বাইরে গোলমালের শব্দ শুনে আমি নিচতলার পার্কিংয়ে চলে যাই। তখন আমাদের ভবনের ছয়তলার বাসিন্দা মুসা, মুসার বাবা ও দাদীকে নিচে দেখতে পাই। আমরা সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাইরে তখন তীব্র গোলাগুলি চলছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ভবনটি রামপুরা থানার ঠিক বিপরীতে অবস্থিত। হঠাৎ দেখি থানার দিক থেকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি মুসার মাথায় লাগে। সাথে সাথে মুসার বাবা তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়। একই গুলি মুসার মাথা ভেদ করে তার পাশে দাঁড়ানো দাদীর পেটে গিয়ে লাগে। দাদী সিঁড়ির দিকে উঠতে গিয়ে পড়ে যান। রক্তে সিঁড়ি ভিজে যায়। আমরা তাকে ধরাধরি করে রিকশায় হাসপাতালে পাঠাই।’

ইয়াকুব জানান, ওইদিন সন্ধ্যা ৬-৭টার দিকে মুসার বাবা ফোন করে দাদীর খোঁজ জানতে চান। তিনি বলেন, আমি তখন বলি, মুসার মাথায় যে গুলি লেগেছিল, সেটিই মুসার দাদীর পেটে গিয়ে লেগেছে। পরে আমরা তাকে ফরাজি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

তিনি আরো বলেন, ‘সেদিন থানার দিক থেকে ছোড়া গুলি আমার দোকানের শাটারে ও বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে লাগে। এখনো গুলির দাগ রয়েছে। পরদিন সকালে জানতে পারি, মুসার দাদী মারা গেছেন।’ ইয়াকুব আদালতকে জানান, ‘পরে জানতে পারি, একই দিনে আমাদের এলাকার শুকুর আলীর জামাই নাদিম মসজিদের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।’ তিনি আরো বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এবং তিনি ঘটনাস্থল সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করেছেন।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সাইমুম রেজা তালুকদারসহ অন্যরা।

গত ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দেন গুলিবিদ্ধ বাসিত খান মুসার বাবা মো: মোস্তাফিজুর রহমান। জবানবন্দীতে গত বছরের ১৯ জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। নিজের চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ হয় একমাত্র ছেলে মুসা। সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। কিন্তু গুলিটি ছেলের মাথা ভেদ করে লাগে মায়ের পেটে। এতে শহীদ হন তার মা মায়া ইসলাম। সাক্ষ্যের একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মোস্তাফিজ। পরে তাকে জেরা করা হয়। ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন আসামি চঞ্চল। ১৬ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। তিনি এ মামলা থেকে চার আসামির অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন।

এ মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন- রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। হাবিবুর ছাড়া পলাতক অন্য তিন আসামি হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো: রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো: মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে, ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। গত ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি। ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির। কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়েন এক পুলিশ সদস্য। এতে তিনতলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ।

এ ছাড়া একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মায়া ইসলাম নিহত হন। একইসাথে মায়া ইসলামের ছয় বছর বয়সী নাতি বাসিত খান মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলেও এখনো কথা বলতে পারছে না এই শিশু।

গত ২৬ জানুয়ারি রাতে আমির হোসেনকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো সাবেক এএসআই চঞ্চল সরকারকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here