
গত সরকারের আমলে যে কয়েকটি ব্যাংক লুটপাটের কারণে সংকটে পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি পদ্মা ব্যাংক। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করেছিল।
আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধনÑসহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও আইসিবি। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তবে গ্রাহকের আস্থা আর ফেরেনি। নাফিজ সরাফাতও শেষ পর্যন্ত গত বছরের শুরুতে পদ্মা ব্যাংক ছেড়ে চলে যান। ব্যাংকটিকে এমন কোনো সুবিধা নেই, যা এটিকে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও শেষ পর্যন্ত পদ্মা ব্যাংক নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি।
বর্তমানে ব্যাংকের মূলধন ঋণাত্মক, ঋণের ৯২ শতাংশ খেলাপি, সুদ আয় ঋণাত্মক এবং তারল্য ঘাটতিসহ সব আর্থিক সক্ষমতা সূচকে অবস্থা সংকটাপূর্ণ। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ অবস্থা উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ-সাইট সুপারভিশন একীভূত বা অবসায়নের মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যাংক রেজুলেশন ডিপার্টমেন্টকে সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এসব সূচকে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩০ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময় ছিল ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ ছাড়া চলতি আমানত ও স্বল্প সুদবাহী আমানতের পরিমাণ যাথাক্রমে ২৭১ কোটি ও ২০৩ কোটি টাকা। উচ্চ সুদের আমানত ৩ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা।
২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ছিল ৫ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশই ছিল খেলাপি। গত বছরের একই সময় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। ব্যাংক মোট ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে মাত্র ১১ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে।
চলতি বছরের জুনে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় ছিল ৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের মূলধন ঝুঁকিজনিত সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) নেমে এসেছে ঋণাত্মক ১৫০ দশমিক ২৭ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিক কাঠামো ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী থাকা উচিত ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ। সিআরএআর হচ্ছে, একটি ব্যাংকের মূলধন ও তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত, যেখানে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী সম্পদের হিসাব নির্ধারণ করা হয়।
ব্যাংকটির ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে পদ্মা। পাশাপাশি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় গ্রাহকের আস্থা তলানিতে পৌঁছেছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ব্যাংক সুদ থেকে আয় করেছে মাত্র ৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ সময় সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ৬৭৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। গত বছর নিট সুদ আয় ঋণাত্মক হয় ৬২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ফলে গত বছর ব্যাংকের সব মিলিয়ে লোকসান হয়েছে ৯৬৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে নিট সুদ আয় ৪০৭ কোটি টাকা ঋণাত্মক। এ ছয় মাসে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫০৩ কোটি টাকা। ব্যাংকের মোট ৬০টি শাখার মধ্যে ৫৯টি লোকসানে।
বিদ্যমান নিয়মে একটি ব্যাংকের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের (বেশিরভাগই আমানত) চার শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে হয়। আর সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ বা এসএলআর হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ রাখতে হয় ১৩ শতাংশ। তবে ব্যাংক সেই অনুযায়ী তারল্য রাখতে পারছে না। তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের বর্তমান সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতি যথাক্রমে ১৭৩ কোটি এবং ২১৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।