স্নাইপার দিয়ে মাথায় গুলি করা হয়

logo

নিজস্ব প্রতিবেদক
মুদ্রিত সংস্করণ

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও ঝাঁকুনি-দেয়া সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘স্নাইপার রাইফেল দিয়ে টার্গেট করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাথায় গুলি করা হয়েছে।’

এই ভয়াবহ অভিযোগের সাক্ষ্য দেন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহ্বায়ক এবং আন্দোলনের অন্যতম মুখ, আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি এই মামলায় ৪৮তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন। তার জেরা অব্যাহত থাকায় আজ সোমবার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এই বেঞ্চে অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

জুনায়েদ ট্রাইব্যুনালের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে স্নাইপার দিয়ে মাথায় গুলি করা হয়। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন গুলি নয়, এটি ছিল টার্গেট কিলিং। আমি নিজে প্রায় ১৫ জনকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন, তাই আন্দোলনকারীরা মাঠে ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হয় পরিকল্পিত গুলি; সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ একত্রে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়।’

সাক্ষ্যে আলী আহসান জুনায়েদ দাবি করেন, যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড, সায়েদাবাদসহ আশপাশের এলাকায় শতাধিক মানুষকে হত্যা করে গুম করে ফেলা হয়। রায়েরবাজার কবরস্থানে ১৩৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়, যার মধ্যে অনেকেই ছিল আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্র।’ তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসায় বাধা দেয়া হয়, এমনকি হাসপাতালেই গুলি করা হয়। এটি শুধু গণহত্যা নয়, এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধ।’

এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে জুনায়েদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৩টায় শেষ হয়। জুনায়েদ ডায়াসে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ (আপ বাংলাদেশ)-এর প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক। এরপর তিনি কোটাবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন।

ট্রাইব্যুনালে গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তারেক আবদুল্লাহসহ অন্যরা।

বেলা ১১টার পর দ্বিতীয় দিনের মতো ট্রাইব্যুনালে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে অবশিষ্ট জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় তার জেরা শেষ হয়। এর আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর বেলা সোয়া ১১টা থেকে ট্রাইব্যুনালে ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেন এনসিপির এই আহ্বায়ক।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রথম দিনের মতো জবানবন্দী দেন নাহিদ। একই দিন বেলা পৌনে ১১টা থেকে দ্বিতীয় দিনের মতো দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেরা করেন আমির হোসেন। এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের ১৯তম কার্যদিবসে মোট জবানবন্দী দিয়েছেন ৪৮ জন। আরো তিনজনের সাক্ষ্য নেয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।

সাক্ষীদের জবানবন্দীতে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বীভৎস বর্ণনা উঠে এসেছে। আর এসবের জন্য দায়ী করে শেখ হাসিনা, কামালসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন শহীদ পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here