দক্ষিণ এশিয়া ও গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ, ফুঁসছে নেপাল

logo

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

(১ ঘন্টা আগে) ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন

mzamin

facebook sharing button
twitter sharing button
skype sharing button
telegram sharing button
messenger sharing button
viber sharing button
whatsapp sharing button

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি সবসময়ই অস্থিরতার জন্য আলোচিত, সমালোচিত। এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্রের দাবি করলেও শাসনব্যবস্থার ভেতরে কর্তৃত্ববাদ, দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় দমননীতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসকরা নিজেদের মত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন ক্ষমতার জোরে। যে জনগণের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় যান, সেই জনগণের ওপর ‘চাপিয়ে দেয়া নীতি’ প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। এটা তারা বুঝেও বোঝেন না। অথবা বুঝলেও ভান ধরে থাকেন। ভাবখানা এমন- তিনি শাসক তার হুকুম মানতেই হবে। তিনি বা তারা শাসক। ফলে যা বলবেন সেটাই আইন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল- এসব দেশে সেই জনগণের গণঅসন্তোষ প্রবলভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে। যে বিতর্কই করুন, সেই বিস্ফোরণের মাত্রা এতটাই তীব্র হয়েছে যে, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী দেশ থেকে গোপনে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। একটি দেশে যখন শাসকগোষ্ঠী বা শাসক দাবি করেন তিনি জনগণের, তার জনপ্রিয়তার সঙ্গে তুলনা দেয়ার কিছু নেই- সেই শাসক যখন জনরোষে পালিয়ে যান, তা কতখানি লজ্জার সেটা পরিমাপের কোনো বাটখারা আবিষ্কার হয়নি। শ্রীলঙ্কাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল রাজাপাকসে পরিবার। তাদের পতন ঘটে এক তীব্র গণঅভ্যুত্থানে। পালাতে বাধ্য হন তখনকার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে, তার প্রধানমন্ত্রী ও ভাই মাহিন্দ রাজাপাকসে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর যে সময় থাকে, সেই সময়কে তারা অতিবাহিত করেন। ফলে জনরোষ থেকে আত্মরক্ষা করতে রাজপ্রাসাদ ছাড়েন। পালান। সে ইতিহাস আমরা কম-বেশি জানি।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার জুলাই ২০২৪-এ গণঅভ্যুত্থানে পতিত হয়েছে। তাদের মুখে মুখে ছিল জনসমর্থনের বুলি। কিন্তু তারা যে জনসমর্থনের দোহাই দিতেন, দম্ভ করে বিরোধী পক্ষকে হেয় করে মস্করা করতেন, সেই জনসমর্থন শেষের দিনগুলোতে কোথায় গেল! কেন পালাতে হলো শেখ হাসিনাকে? সময় থাকতে তিনি পদত্যাগ করলে তার কি পালানোর মতো লজ্জার পরিণতি ভোগ করতে হতো! এক্ষেত্রে হয়তো অন্য হিসাব আছে তার। তিনি হয়তো ভেবেছেন ক্ষমতা ছেড়ে দিলে তার পরিণতি করুণ হতে পারে। তারচে’ ওপাড়ে গিয়ে বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করাই ভাল। তাতে কোনো কোনো মহলের সমর্থন থাকবে। নিজের জীবন হবে নিরাপদ। তিনি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসতে থাকে ‘কালো বিড়াল’। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছিল। কি পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে তা চিন্তা করতে গেলে চোখ আকাশে ওঠে। ইন্দোনেশিয়ায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে উত্তাপ বেড়ে চলেছে। নেপালে আবার জেনারেশন-জেড তরুণরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এই প্রবল অস্থিরতার মধ্যে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সরকার টিকে থাকতে পারবে কি না? এই নিবন্ধে আমরা তারই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।

শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা: রাজাপাকসে সাম্রাজ্যের পতন

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে দেশ অচল হয়ে যায়। জনগণ যখন বিক্ষোভে রাস্তায় নামে, তখন রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। অবশেষে জুলাইয়ের উত্তাল আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, যে কোনো শাসকগোষ্ঠী যদি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক কুশাসনের দায়ে জনগণের আস্থা হারায়, তবে তা টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা: হাসিনার পতন

বাংলাদেশেও একই ধরণের বাস্তবতা দেখা গেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তবে নির্বাচন নিয়ে কারচুপি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধীদের দমননীতি এবং দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। শিক্ষার্থী-শ্রমিক-যুবক- সবাই রাস্তায় নেমে আসে। সরকার পুলিশের দমননীতি ব্যবহার করলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেই কেবল জনগণ শাসককে সহ্য করবে তা নয়। রাজনৈতিক বৈধতা হারালে, জনগণ রাস্তায় নেমে আসলেই কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না।

ইন্দোনেশিয়ার অস্থিরতা

ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র। কিন্তু দেশটি এখন প্রবল রাজনৈতিক উত্তাপে রয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ইসলামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আঁতাত নিয়ে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। রাজধানী জাকার্তাসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ চলছে। যদিও ইন্দোনেশিয়ার পরিস্থিতি এখনও শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের মতো বিস্ফোরক হয়নি, তবে প্রবণতা স্পষ্ট। যুবসমাজ ক্রমেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে এবং পরিবর্তনের দাবি তুলছে।

নেপালের বর্তমান সংকট

নেপালে জেন-জি তরুণদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা নতুন এক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সরকারের দাবি ছিল, এসব প্ল্যাটফর্ম ভুয়া আইডি, ঘৃণামুলক বক্তব্য, ভুয়া খবর ও প্রতারণার কারণে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, তরুণরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা আন্দোলনে নেমে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হন। অবশেষে সরকার পিছু হটে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এ থেকেই বোঝা যায়, নেপালে তরুণ প্রজন্ম কোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা সরাসরি রাষ্ট্রের ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়াতে রাজি।

কেন নেপালে যুবসমাজ ক্ষুব্ধ?

১. দুর্নীতি: নেপালের জনগণ মনে করে, দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সরকারি প্রকল্প, নিয়োগ, লাইসেন্স- সব জায়গায় দুর্নীতির অভিযোগ।

২. অর্থনৈতিক সংকট: প্রতিবেশী ভারতের ওপর নেপালের অর্থনৈতিক নির্ভরতা প্রবল। বেকারত্ব ও দারিদ্র‍্য তরুণদের ক্ষোভ বাড়িয়েছে।

৩. সামাজিক বৈষম্য: রাজনীতিবিদদের পরিবার বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, অথচ সাধারণ জনগণ দারিদ্রে‍্য ভুগছে। টিকটকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলো এই বৈষম্যকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।

৪. রাজনৈতিক অচলাবস্থা: নেপালে ক্ষমতার লড়াই এবং জোটভাঙা-জোটগড়া রাজনীতির কারণে স্থিতিশীলতা নেই।

কেপি শর্মা ওলির সরকারের ভবিষ্যৎ

ওলি সরকার আপাতত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করা কেবল একটি অজুহাত ছিল। প্রকৃত ইস্যু হচ্ছে দুর্নীতি, বেকারত্ব, বৈষম্য ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা। যদি এসব সমস্যার সমাধান না করা হয়, তবে আগামী দিনগুলোতে আরও বড় আন্দোলন শুরু হতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ

একটি বিষয় স্পষ্ট- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। ইন্দোনেশিয়ায় উত্তপ্ত প্রতিবাদ।  জেন-জি ফুঁসছে নেপালে। এ ধারাবাহিকতা ইঙ্গিত দেয় যে, এ অঞ্চলের তরুণ প্রজন্ম গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছ শাসনের দাবিতে সরব হচ্ছে।

নেপালের সামনে চ্যালেঞ্জ

নেপালের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক পুনর্গঠন। এর মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র‍্য দূরীকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি দমন: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণদের অংশগ্রহণ: জেনারেশন-জেডকে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রতিবেশী সম্পর্ক: ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

নেপালের ওলি সরকার আপাতত রক্ষা পেলেও, বাস্তবতা হলো- এখন আর পুরোনো ধাঁচের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের উদাহরণ তা প্রমাণ করেছে। অন্য শাসকদের, বিশেষ করে এশিয়ার শাসকদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনা থেকে। যদি সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে অচিরেই নেপালও প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখোমুখি হতে পারে। জেন-জি তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভই হতে পারে সেই পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here