- ২৪ ডেস্ক
- জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এছাড়া, জুলাই অভ্যুত্থান, গণহত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িতদের এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়েও অধিকাংশ দল একমত। সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের প্রথম দফা আলোচনা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।
বাংলাদেশ সরকারের লোগো
সংবিধান সংস্কার: আলী রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত হলেও ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। দ্বিকক্ষ আইনসভার ব্যাপারে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একমত, যদিও কিছু দল এককক্ষ বহাল রাখার পক্ষে। নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণে ঐকমত্য থাকলেও পদ্ধতির বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। উভয় কক্ষের সমর্থক ও এককক্ষের সমর্থক উভয় পক্ষই ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার পক্ষে। উচ্চকক্ষ ১০০ সদস্যের করার বিষয়ে ঐকমত্য থাকলেও প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত ৪৮(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধনেও দলগুলো একমত। তবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য এবং ৭০ অনুচ্ছেদ (দলের বিপক্ষে ভোটদান) পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অর্থ বিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনে দলীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতায় অধিকাংশ দল একমত, কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিলও যুক্ত করতে চান। আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত।
জনপ্রশাসন সংস্কার: জুলাই অভ্যুত্থান, গণহত্যা, নিপীড়ন, ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে। ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ এবং ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩’ সংশোধন করার প্রস্তাবে সব দল নীতিগতভাবে একমত। বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে ৮ সদস্য বিশিষ্ট পৃথক তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত। সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপন করার অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত। জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করার প্রস্তাবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত। পৌরসভার চেয়ারম্যান সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়েও একমত পোষণ করেছে অধিকাংশ দল। হিসাব বিভাগ হতে অডিট বিভাগ আলাদা করার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে, দেশের পুরাতন চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা, বিদ্যমান জেলা পরিষদ ব্যবস্থা বাতিল করা, ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে পৌরসভার চেয়্যারম্যান নির্বাচিত হওয়া, এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বিলুপ্ত করার প্রস্তাবে বেশিরভাগ দল একমত হয়নি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘নাগরিক কমিটি’ গঠনের ব্যাপারে দলগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের অধিকাংশ সুপারিশের পক্ষেই রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, দুদকের স্বাধীনতা, কার্যকরতা, গতিশীলতা, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান। দুর্নীতিবিরোধী ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি এবং তাকে ক্ষমতায়িত করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হলেও বিষয়টি অমীমাংসিত রয়েছে। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আনীত প্রস্তাবে দলগুলো নীতিগতভাবে বা আংশিকভাবে একমত হয়েছে। সেবা প্রদানকারী সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় আনা, কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধে কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ও ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে বাংলাদেশের যোগদান এবং বেসরকারি খাতের ঘুষ লেনদেনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশের বিষয়ে সব দল একমত।
বিচার বিভাগ সংস্কার:নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথকীকরণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের সুপারিশে সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। বিচারকদের চাকুরির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধনেও সবগুলো দল একমত। বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করার সুপারিশে সকল দল একমত। স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠায় দলগুলো নীতিগত বা আংশিকভাবে একমত। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রদ করে আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত, যদিও কোনো কোনো দল প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা ৭ জন নির্ধারণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাবে সব দল একমত। জুডিসিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ এবং শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থার সুপারিশের সাথে সবদল নীতিগত একমত। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন আইন প্রণয়ন ও বোর্ডের সুপারিশে ক্ষমা প্রদর্শনের সুপারিশে একটি-দুটি দল ছাড়া বাকিরা একমত। আইনগত সহায়তাকে অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের সুপারিশে সকল দল একমত। তবে আইনজীবী সমিতি নির্বাচন এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বিলোপের প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার: নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করার ব্যাপারে সব দল একমত। দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিধান এবং ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠনের ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত, তবে এ ব্যাপারে মতের ভিন্নতা আছে। নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির নিকট উপস্থাপনের বিধান করার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করার ব্যাপারে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একমত। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’-এর আওতাভুক্ত করার প্রস্তাবে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বারিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো, এর আইনি দিক বিবেচনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকার ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলো ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে। পরবর্তীতে ১২ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা তার নেতৃত্বে এবং বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের প্রিন্ট কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রেরণ করে তাদের মতামত নেয় এবং ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে’র মধ্যে মোট ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনে আলোচনা সম্পন্ন করে।