এক সময় বিড়ি বানানো সুরেন্দ্র এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক

logo

মানবজমিন ডেস্ক

১৫ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবারmzamin

 সুরেন্দ্র কে. প্যাটেল (৫১)। ভারতের দক্ষিণে কেরালায় জন্মগ্রহণ করেছেন। তার পিতামাতা ছিলেন দিনমজুর। তাদের আয়ে ৬ সন্তানের ভরণপোষণ চলতো। শৈশবে এই কষ্টের সঙ্গী হয়েছেন সুরেন্দ্র প্যাটেল। তিনিও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজের হাতে বিড়ি বানিয়েছেন। পাতায় তামাক পেঁচিয়ে বিড়ি বানিয়ে দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টা করেছেন। অনেক রাত পর্যন্ত বড় বোনের সঙ্গে বিড়ি বাঁধতেন। যাতে দিনে তিনবেলা খাবার জোটে। দারিদ্র্যের টানাপড়েনে টিনেজ অবস্থায়ই স্কুল থেকে ঝরে পড়েন।

কারণ, পরীক্ষায়  মোটেও ভালো করেননি। সেই সুরেন্দ্র কে. প্যাটেল এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক। গত সপ্তাহে তিনি টেক্সাস রাজ্যের ফোর্ট বেন্ড কাউন্টিতে ২৪০তম জুডিশিয়াল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের একজন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। শপথ নিয়েছেন। ফলে তার এই উৎসাহমূলক কাহিনী ভারত সহ বিভিন্ন স্থানে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার ৫ বছর পরে নতুন বছরে ১লা জানুয়ারি তিনি বিচারক হিসেবে শপথ নিয়েছেন। বলেছেন, এই সফলতার  পেছনে তার কঠোর পরিশ্রম, সংকল্প এবং সংগ্রামের কথা। সুরেন্দ্র প্যাটেল বলেছেন, অনেক মানুষ আছেন। তাদের সমর্থন এবং সহায়তা আছে আমার জীবনের প্রতিটি স্তরে। এই তালিকায় শীর্ষে আছেন আমার মা। তিনি হলেন ‘আত্মত্যাগের এক প্রতীক’।
এক পর্যায়ে তার বড় বোন ১৫ মাসের কন্যাকে রেখে মারা যান। ফলে সুরেন্দ্রকে জীবনে বড় এক বোঝা কাঁধে নিতে হয়। তিনি বলেছেন, তার বোনের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন এ বিষয়ে সুবিচার পাননি। তার ভাষায়Ñ এই বেদনা এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এই বিয়োগান্তক ঘটনা তার ভবিষ্যৎকে নতুন করে ভাবায়। তিনি আবার স্কুলে যোগ দেন। কঠোর পড়াশোনা করেন। কলেজে যাওয়ার আগে দুই বছরের প্রি-ডিগ্রি কোর্টে থাকাকালে তাকে অনেক ক্লাস মিস করতে হতো। এর কারণ কঠোর পরিশ্রম। ফলে  উপস্থিতি অনেক কম হওয়ার পর শিক্ষকরা তাকে ফাইনাল পরীক্ষা না দেয়ার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি তাদের কাছে অনুনয় করতে থাকেন। সুরেন্দ্র  কে. প্যাটেল বলেন, আমার আর্থিক অবস্থার কারণে ক্লাসে যোগ দিতে পারিনি, এ কথা শিক্ষকদের জানাতে চাইনি। কারণ, আমি চাই না কেউ আমাকে সহানুভূতি দেখাক।
শিক্ষকরা তাকে আরেকটি সুযোগ দিলেন। পরে তারা সুরেন্দ্রর বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, সুরেন্দ্রর কাজ করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। এ অবস্থায় যখন পরীক্ষার ফল বেরুলো তখন ক্লাসে দ্বিতীয় হয়ে সবাইকে চমকে দিলেন সুরেন্দ্র। সিদ্ধান্ত নিলেন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবেন আইনে। বলেন, আর কিছুই করতে চাইনি কখনো। আইনের প্রতি আমি এতটাই মোহময় হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তার আর্থিক পরিস্থিতি সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে আসতেই থাকে। এই চলার পথে তিনি কিছু উদার মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তাদের সহায়তা পেয়ে যান তিনি। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন উত্থপ। তিনি কেরালায় একটি হোটেল পরিচালনা করেন।
সুরেন্দ্র প্যাটেল বলেন, আমি তাকে বললাম সে যদি আমাকে একটি কাজ না দেয়, তাহলে পড়াশোনায় ইতি ঘটাতে হবে। সে আমাকে হোটেলের হাউজকিপিং স্টাফ হিসেবে কাজে নিলো। মিস্টার উত্থপ মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অটুট ছিল। আমি বিচারক হয়েছি এ খবর জানার পর তার ভাই ম্যানুয়েল ফোন করেছিলেন আমাকে।
আইন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার আগে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি ডিগ্রি অর্জন করেন সুরেন্দ্র কে. প্যাটেল। চার বছর পরে তিনি আইনজীবী পি. আপ্পুকুত্তানের সঙ্গে একটি কাজ পান। কেরালার কাসারাগড় জেলায় হসদুর্গ শহরে কাজ শুরু করেন। আইনজীবী আপ্পুকুত্তান বলেছেন, তিনি এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে, আমি তাকে বিশ্বাস করতাম। সব রকম দেওয়ানি মামলা আমি তার ওপর ন্যস্ত করলাম, যাতে তিনি তা চালিয়ে নিতে সক্ষম হন।
রাজধানী দিল্লিতে একটি হাসপাতালে কাজ পান সুরেন্দ্র প্যাটেলের স্ত্রী শুভা। তার আগে এক দশক পর্যন্ত আপ্পুকুত্তানের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। স্ত্রীর চাকরি পাওয়ার সুবাদে তিনিও চলে যান দিল্লিতে। কারণ, তিনি কখনো স্ত্রীর ক্যারিয়ার আটকাতে চাননি। এবার যুক্তরাষ্ট্রে কাজ পেয়ে যান শুভা। তার আগে কয়েক মাস সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর সঙ্গে দিল্লিতে কাজ করেন সুরেন্দ্র। তিনি বলেন, আমার এই কাজ ফেলে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমি সন্তুষ্ট নই। তবু শুভাকে অনুসরণ করতে হলো। আজ আমি যেখানে, তার অবদান ছাড়া এখানে কখনো আসতে পারতাম না।
এই দম্পতি ২০০৭ সালে টেক্সাসে পাড়ি জমান। সেখানে কিছু সময় একটি মুদি দোকানে কাজ করেন সুরেন্দ্র প্যাটেল। কিছু সময় পরে তার মনে হলো টেক্সাসে তাকে বার পরীক্ষা দেয়া উচিত। এরপর আন্তর্জাতিক আইনে ডিগ্রি অর্জনে নেমে পড়েন। ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে একজন বিচারকের পদে দায়িত্ব পালন পর্যন্ত কিছু অসন্তোষজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। প্রচারণা চালানোর সময় ভারতীয় উচ্চারণের জন্য তাকে নিয়ে হাসিতামাশা করা হয়েছে। সুরেন্দ্র বলেন, এতে আমি আহত হইনি। প্রচারণা তো মাঝে মাঝে বাজেও হতে পারে। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন মানুষের সেবা করবো।
আমেরিকার এই জার্নি সম্পর্কে তিনি বলেন, মাত্র ২০১৭ সালে আমি নাগরিকত্ব পাই। আর এখন সবেমাত্র ২০২৩ সাল। একটি নির্বাচন জিতেছি। মনে করি, অন্য কোনো দেশে এই ঘটনা ঘটতে পারে না।