আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধারায় উল্লিখিত শর্ত পর্যন্ত এ চুক্তির প্রায় সব বিষয়বস্তুই অত্যন্ত গোপন ছিল দীর্ঘদিন। এমনকি বিপিডিবির সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, এ চুক্তি নিয়ে চার বছরেরও বেশি সময় অন্ধকারে ছিলেন তারা। হাতে গোনা সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বাইরে এ চুক্তির বিষয়বস্তু নিয়ে কেউই কিছু জানত না।
বকেয়া পাওনা নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আদানি গ্রুপের দেন-দরবারের বিষয়গুলো নিয়েও ব্যাপক মাত্রায় গোপনীয়তা বজায় রেখেছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। এরও আগে চুক্তি প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় দফায় দফায় গোপনে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন আদানি গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এমনকি গ্রুপটির কর্ণধার গৌতম আদানিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বুঝিয়ে দিতে গত বছর ৩ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিষয়গুলো নিয়ে আদানি পাওয়ারের কোনো কর্মকর্তা বা শীর্ষ নির্বাহী কখনই বাংলাদেশী গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি।
এ বিষয়ে জানতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিপিডিবির সাবেক এক ও বর্তমান দুই শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তারা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তিটিতে অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। এটি নির্মাণে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তির খসড়াটি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হলেও তা বিপিডিবিকে দেয়া হয়নি। এমনকি চুক্তিতে সইয়ের সময়ও বিপিডিবির কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের প্রশ্ন করার ওপর শীর্ষ পর্যায় থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয়েছিল। আদানি পাওয়ারের প্রস্তাবে কোনো ধরনের দরকষাকষি ছাড়াই সই করেছে বিপিডিবি।
সাবেক ও বর্তমান এ কর্মকর্তাদের দাবি, আদানির সঙ্গে চুক্তি সই হওয়ার পর অন্তত সাড়ে চার বছর এ চুক্তির বিষয়ে জানতে পারেননি তারা।
এ দেশের বিদ্যুৎ খাতে আদানি গ্রুপের ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয় মূলত ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়। এর দুই বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার ও বিপিডিবি এ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সই করে। দীর্ঘ সময় গোপন থাকা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির ১৬৩ পৃষ্ঠার একটি নথি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টে ফাঁস হয়। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কয়লার দাম বেশি রাখাসহ এর বিভিন্ন অসম ধারার তথ্য প্রকাশ পায়। একপর্যায়ে কয়লার দাম ও ক্রয়পদ্ধতি পর্যালোচনার জন্য নয় সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এরপর বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদানি পাওয়ারের একটি প্রতিনিধি দল অনেকটা নীরবে ও আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ সফর করে যায়। ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন আদানি পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিল সারদানা, একজন ক্রয় কর্মকর্তা ও বাংলাদেশের আদানি পাওয়ারের এক কর্মকর্তাসহ মোট পাঁচজন। সংক্ষিপ্ত এ সফরে বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক শেষে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতেই তারা ভারতে ফিরে যান।
বাংলাদেশে গড্ডার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে রফতানি শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর ঘোষণা আসে আরো পরে। গত বছরের জুলাইয়ে ৩ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকা আসেন আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে স্থানীয় সময় অনুযায়ী বেলা ১১টায় ঢাকায় অবতরণ করেন তিনি। নেমেই দেখা করতে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। ঘণ্টাখানেক বৈঠক সেরে ওইদিন বেলা ১টায় ফিরে যান ভারতে। পরে এক টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো সক্ষমতায় উৎপাদন বুঝিয়ে দিতে পেরে (আমি) সম্মানিত।’
সে সময় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর তিন মাসেও কোনো অর্থ পায়নি আদানি পাওয়ার। বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র বুঝিয়ে দিতে আসার কথা বলা হলেও সেদিন আদানির বাংলাদেশে আগমনের বড় উপলক্ষ ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ বকেয়া। গৌতম আদানির ওই সফরের দুই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ আদানি পাওয়ারকে প্রথম ১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের বিল পরিশোধ করা হয়।
আদানি পাওয়ারের বিল বকেয়া পড়ে যাওয়া নিয়ে বড় ধরনের জটিলতার সূত্রপাত হয় গত বছর। বকেয়া পড়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ পাওনা আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় বিপিডিবির সঙ্গে চিঠি আদান-প্রদানের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেয় আদানি পাওয়ার। বিষয়টি নিয়ে আদানি পাওয়ারের কর্মকর্তারা বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির সঙ্গে নানা সময় বৈঠকও করেছেন।
চলতি বছরের মে মাসে আদানির বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে বাংলাদেশ সফর করে তাগাদা দিয়ে যান গ্রুপটির পরিচালক প্রণব আদানি। গৌতম আদানির ভ্রাতুষ্পুত্র প্রণব আদানি বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। গ্রুপটির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। এ বছরের মে মাসে প্রণব আদানির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। বৈঠকে আদানি গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা অনিল সারদানা, এস বি খিলিয়া, বিপুল যাদব ও অভিষেক তিয়াগি উপস্থিত ছিলেন। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। বৈঠকে ভারতের কাছ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়ার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় আদানি গ্রুপের বিদ্যুতের বিল নিয়মিত পরিশোধের অনুরোধ করা হয়।
পাশাপাশি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে আরো বিনিয়োগের আগ্রহও প্রকাশ করে আদানির প্রতিনিধিরা। বৈঠক শেষে সে সময় প্রণব আদানি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘আমরা মনে করি বাংলাদেশে অনেক সুযোগ রয়েছে। এখানে বিনিয়োগ করার বিষয়ে আমরা কী ভূমিকা পালন করতে পারি সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
আদানি গ্রুপে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও প্রণব আদানি অন্যদের তুলনায় কিছুটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই রয়েছেন। বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের কার্যক্রম মূলত তিনিই তত্ত্বাবধান করছেন। গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানির ছেলে প্রণব আদানি। হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের ঘটনায় বিনোদ আদানির নামও এসেছিল।
বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গ্রুপটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর করেছেন। যদিও এসব সফরের বিষয়বস্তুর প্রকৃত তথ্য কখনই গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি। আর শেখ হাসিনার শাসনামলে আদানি পাওয়ারের কর্মকর্তাদের বৈঠক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আদানির সঙ্গে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি ও এর গোপনীয়তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন তারা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়েছে, সেটি গোপনীয়তা বজায় রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটি জানার অধিকার জনগণের আছে। এমনকি সামরিক চুক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের গোপনীয়তার সুযোগ রাখা হয় না। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। অন্যান্য দেশেও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ আছে। যে কারণে আজকে তাদের চুক্তিগুলো নানাভাবে বিতর্কিত হচ্ছে।’
নিয়ম অনুযায়ী, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। আবার তা উভয় দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ দরপত্র প্রকাশ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেটি করা হয়নি। এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জনসাধারণের জানার অধিকার রয়েছে, কত টাকায় এ বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে বা চুক্তিতে কী কী বিষয় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; যার কোনোটাই করা হয়নি বা মানা হয়নি। এ ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই কারিগরি ও বাণিজ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে দরকষাকষির সুযোগ ছিল। আমাদের সে সময় এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে একতরফাভাবে এ চুক্তিতে যেতে হবে। এটি অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে করা হয়েছে। যেখানে কারিগরি, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিষয়টি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থেকেছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নিয়ম প্রক্রিয়া পুরোপুরি অবৈধভাবে করা হয়েছে বলে দাবি তার।’
যদিও আদানি গ্রুপসংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির ক্ষেত্রে আদানির গড্ডা কেন্দ্রের সঙ্গে বিপিডিবির চুক্তিটি নিয়ম মেনেই হয়েছে। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই।
আদানি পাওয়ার-সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের ভাষ্যমতে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসংশ্লিষ্ট বিষয় ও চুক্তির আগে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিপিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৭টি পর্যালোচনা বৈঠক হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি ছিল আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মে মাসে কারিগরি কমিটি করা হয়। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আদানি বিদ্যুৎ বিভাগে লিখিত ও আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। ওই বছরের ৬ এপ্রিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসংক্রান্ত কারিগরি প্রস্তাব দেয়া হয়। একটি টেকনিক্যাল কমিটি সেসব প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দরকষাকষি করতে বলেছে।
বিপিডিবির তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে চালু হওয়ার পর থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে ১৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে ২ হাজার ২৪১ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ হাজার ১৪৭ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। এ বছরের জুন শেষে বিপিডিবির কাছে আদানি পাওয়ারের বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। অবশ্য গত কয়েক মাসে আদানির বকেয়ার পরিমাণ আরো বেড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুতের ক্রয় চুক্তিটি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। এটি নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। তারা কিছু মতামতও দিয়েছে। এখানে এককভাবে বিদ্যুৎ বিভাগের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। কমিটির সুপারিশের ওপর যে সিদ্ধান্ত আসবে তা অনুসরণ করা হবে।’
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ভোজ্যতেল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা খাতে ব্যবসা রয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের। তবে গ্রুপটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে গড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়েই আলোচিত হয়ে উঠেছে আদানি গ্রুপ। বিশেষ করে ভারতীয় ধনকুবের আদানি গ্রুপের চেয়ারপারসন গৌতম আদানি ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল কৌঁসুলিরা ঘুস ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা করার পর থেকেই গ্রুপটি সংবাদমাধ্যমের আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গৌতম আদানি ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র সাগর আদানির কাছে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ঘুসের অভিযোগের বিষয়ে জবাব তলব করেছে। অন্যদিকে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিশাল তিওয়ারি নামক একজন আইনজীবী গৌতম আদানি ও অন্যদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের উত্থাপিত ঘুসের অভিযোগ তদন্তের জন্য আবেদন করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ঘুস ও প্রতারণার দায়ে অভিযোগ দায়েরের পর থেকে ব্যবসায়িকভাবেও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে আদানি গ্রুপ। এরই মধ্যে কেনিয়ার সরকার দেশটিতে আদানি গ্রুপের ৮৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করেছে। বাংলাদেশেও আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিলের দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। গত ২৪ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বাক্ষরিত বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি পর্যালোচনায় সহায়তার জন্য একটি স্বনামধন্য আইন ও তদন্তকারী সংস্থাকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। এ কমিটি যেসব বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনা করছে তার মধ্যে আদানি (গড্ডা) বিআইএফপিসিএল ১,২৩৪ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রও রয়েছে।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আদানিসহ বিদ্যুৎ খাতের অসম চুক্তিগুলো পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই আবারো বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিল বাবদ পাওনা পরিশোধ নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে বিল জটিলতায় আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকির তথ্য সামনে আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততার সঙ্গে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির পাওনা বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়। আদানি পাওয়ারের পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। এক্ষেত্রে আদানি পাওয়ারকে প্রতি মাসে ১০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধের চেষ্টা করা হবে বলে বিপিডিবি সূত্র জানিয়েছে। এ বছরের জুলাইয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ, আগস্টে ২ কোটি, সেপ্টেম্বরে ৬ কোটি ৫০ লাখ, অক্টোবরে ৯ কোটি ৭০ লাখ এবং চলতি নভেম্বরে ৬ কোটি ডলার দেয়া হয়েছে আদানিকে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে আদানি পাওয়ারের ২৫ কোটি ডলারেরও বেশি বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে।