আগামী রোববার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট লাউঞ্জে নবনিযুক্ত পাঁচ কমিশনারের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তাঁদের শপথ পড়াবেন বলে প্রধান বিচারপতির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
আগামী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পাওয়া এই কমিশনের অধীনেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপেজলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্য সব নির্বাচনও হবে এ কমিশনের অধীনে।
চার কমিশনার হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাছউদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ তিন জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের ভোটে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনায় নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এক সময়ে আগ্রহের তুঙ্গে থাকা ভোট থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোটারের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে অনেকেই মনে করছেন, সাবেক সিইসি কাজী রকিব, নূরুল হুদা ও কাজী আউয়াল কমিশনকে কাজ করতে হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত নতুন কমিশন অনেকটাই সহায়ক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পাবে।
এর আগে বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের তালিকা সুপারিশ আকারে পাঠানো হয়। তাদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে বাছাই করে সরকার। আগের তিন নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় সার্চ কমিটির সদস্যরা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে নাম জমা
দিলেও এবার তারা যাননি। এর আগে সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তির কাছ থেকে নাম আহ্বান করা হয়। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির তালিকায় এ এম এম নাসির উদ্দীনের নাম ছিল।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে। ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। ফলে ‘একতরফা ও ডামি’ নির্বাচনের তকমা পাওয়া এ ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনাসহ ওই সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী-এমপি দেশ ছেড়ে পালান। পরদিন সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের সাংবিধানিক নির্দেশনা থাকলেও প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায় ৫ সেপ্টেম্বর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন পদত্যাগ করে। এরপর থেকে সাংবিধানিক এই পদগুলো শূন্য ছিল।
প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, দেশের চতুর্দশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া নাসির উদ্দীন এর আগে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালে অবসরে যাওয়া এই আমলাকে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিল। এবার তাঁকে দেওয়া হলো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। নাসির উদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তিনি সরাসরি ছাত্র ছিলেন। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে তারা দু’জন পরস্পরের সহকর্মীও ছিলেন। নাসির উদ্দীন বিসিএস ১৯৭৯ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা।
প্রজ্ঞাপন জারির পর নাসির উদ্দীন তাঁর ইস্কাটনের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ভোটাধিকার প্রয়োগে মানুষ যেসব বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, সেগুলো ঠিক করাই তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জুলাই-আগস্টে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। এর আগে বহু মানুষ নির্যাতনের শিকার ও গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। তাদের দাবি ছিল, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা। মানুষ মুক্ত পরিবেশে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চেয়েছে। কিন্তু তারা তা পারেনি। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে মানুষ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।
নির্বাচনে সব দলের অংশ নেওয়ার বিষয়ে নানা আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দীন বলেন, এ নিয়ে আগাম কিছু বলা যাবে না। কারণ, বিভিন্ন দল নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। ফলে সময় হলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে।
বিএনপির তালিকায় তাঁর নাম থাকা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কখনও চিন্তাও করেননি যে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। ফলে এই মর্যাদা তিনি রাখার চেষ্টা করবেন। তিনি সততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে।
নাসির উদ্দীন আরও বলেন, ‘১৯৯১ ও ২০০১ সালে মানুষ মুক্তভাবে ভোট দিয়েছে। সে রকম একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটি তো কঠিন কিছু নয়। বিরোধী দল যারা আছে, সব রাজনৈতিক দলই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের নিয়েই তো আমাকে কাজ করতে হবে।’
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আব্দুর রহমানেল মাছউদ (এ আর মাছউদ) তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘দোয়া করবেন। আগামীতে যে কাজই আমার ওপর আসুক, আমি যেন সেটা ভালোভাবে, সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে করতে পারি।’
এদিকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সাবেক জেলা জজ আব্দুর রহমানেল মাছউদ ২০১৭ সাল থেকে ঢাকায় জনতা ব্যাংকের প্রধান আইন পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি জেলা জজ পদমর্যাদায় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১ এর সদস্য হিসেবে অবসরে যান। কর্মজীবনে তিনি কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহীর জেলা জজ ছিলেন। নির্বাচন আইন, দুর্নীতি দমন আইন, ফৌজদারি কার্যবিধিসহ আইনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ১৮টি বই রয়েছে।
নতুন কশিনারদের মধ্যে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম অবসরে যাওয়ার আগে দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে। ৮৫ ব্যাচের সাবেক এই কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদায় তাঁকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। তার আগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমেদ ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই বছরই তিনি প্রথমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং পরে পাট অধিদপ্তরের পরিচালক হন। ১১তম প্রশাসন ব্যাচের কর্মকর্তা তহমিদার স্বামী এহসানুল হকও একই ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। বিগত সরকার ২০২০ সালে তাঁকে মিনিস্টার পদের কূটনৈতিক পদমর্যাদায় এ পদে নিয়োগ দেন। ১৮তম বিএমএ লং কোর্সের এ সেনা কর্মকর্তা ৩৫ বছর মিলিটারি সার্ভিসে ছিলেন।
samakal