আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিসংখ্যান সারা দেশের জন্য উদ্বেগজনক। দেশের কোনো এলাকার এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো এলাকাকে পেছনে ফেলে রাখা অন্যায্য। আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে লিখেছেন জহির রায়হান
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নতুন অধ্যায় পার করছে। সংবিধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, গণভোট, নির্বাচনব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য ও গণমাধ্যম সংস্কারের রূপরেখা ও প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষ ভেবেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসন নিয়ে কাজ শুরু করবে। কিন্তু আশার প্রতিফলন এখনো হয়নি।
উল্টো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৪ সদস্যের ১৩ জন একটি বিভাগের বলে প্রশ্ন উঠেছে। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ থেকে কাউকে নেওয়া হয়নি। উত্তরাঞ্চলের মানুষের ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকারও রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে বৈষম্য করছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সরকারি বৈষম্যের বিরুদ্ধে এত এত প্রাণ গেল; তবু আঞ্চলিক বৈষম্য থামল না। কেন?
মূলত আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০০৭-০৮-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বিশ্বব্যাংক ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনের কথা উল্লেখ করে। ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দেশের উন্নয়ন ও বৈষম্য নিয়ে প্রথম আলো বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল ‘আঞ্চলিক বৈষম্যে বাংলাদেশ বিভক্ত/পূর্বাঞ্চল এগিয়ে, পশ্চিমাঞ্চল পিছিয়ে।’
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে উন্নয়নের একপেশে নীতির কারণে উত্তরাঞ্চল বঞ্চিত হয়েছে। একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ) রংপুর অঞ্চলের জন্য তেমন উন্নয়ন প্রকল্প ছিল না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হতো, তার ছিল ১ শতাংশের কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারর্সের (বিআইপি) তথ্য অনুযায়ী, এডিপিতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া জেলাগুলো হচ্ছে নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও বগুড়া।
অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জ জেলা বেশি বরাদ্দ পেয়েছিল। এডিপির ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ পায় এই তিন জেলায়। অর্থাৎ এডিপিতে ১০০ টাকা বরাদ্দ থাকলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জ পায় ৩৭ টাকা ৪০ পয়সা। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগা প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ ছিল ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চলকেন্দ্রিক। অন্যান্য বিভাগে দু-একটি থাকলেও রংপুর বিভাগে একটিও ছিল না।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার সরকারি ও বেসরকারিভাবে ১০৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে মাত্র ৪টি। রংপুর একমাত্র বিভাগ, যেখানে অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলও চালু হয়নি। এমনকি অবকাঠামো নির্মাণেরও খবর নেই।
স্থানীয় সরকার ও অবকাঠামো উন্নয়নে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পায় যথাক্রমে ১ হাজার ২০৩ ও ৭৭৪ কোটি টাকা। সেখানে রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৪৩ কোটি টাকা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, প্রবাসীকল্যাণসহ প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রংপুর বিভাগে অল্প বরাদ্দে নামমাত্র প্রকল্প দেওয়া হয়েছে।
আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিসংখ্যান
আঞ্চলিক বৈষম্যের এই পরিসংখ্যান সারা দেশের জন্য উদ্বেগজনক। দেশের কোনো এলাকার এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো এলাকাকে পেছনে ফেলে রাখা অন্যায্য। অথচ তা-ই করা হয়েছে। দারিদ্র্য যেখানে বেশি, সেসব এলাকায় বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে কম।
মূলত রংপুর বিভাগে শিল্পায়ন তেমন নেই। অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ কম। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতেও বরাদ্দ কম আসে। অথচ দারিদ্র্য, বন্যা, নদীভাঙন, বেকারত্ব এখানকার প্রধান সমস্যা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—মানব উন্নয়নের কোনো সূচক নেই, সেখানে রংপুর পিছিয়ে নেই।
যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুসারে, ছয় বছরে রংপুর বিভাগে অর্ধেক দারিদ্র্য কমে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালে এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৭ দশমিক ২ (প্রথম আলো ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩)।
অন্যদিকে বিবিএসের ‘আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিপরীত তথ্য উঠে এসেছে। গত ২৮ জুন প্রকাশিত তথ্য বলছে, কৃষি দিনমজুর বেশি রংপুরে। বিভাগটির মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ কৃষিকাজে দিনমজুরি করে।
রংপুরের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখেছি, একজন দিনমজুর সারা দিন পরিশ্রম করে ফেরার সময় চাহিদামতো খাদ্যসামগ্রী কিনতে সক্ষম নন। স্বাস্থ্য ও সন্তানের শিক্ষার খরচ চালাতে পারেন না। তাঁর টিনের ঘরে খালি চোখে দারিদ্র্যচিত্র দেখা যায়। তাহলে দারিদ্র্যের হার বাস্তবে কমেছে কি? নাকি শুধু পরিসংখ্যানে?
অমর্ত্য সেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বাংলায় খাদ্যশস্যের কোনো সংকট ছিল না, সংকট ছিল খাদ্যবণ্টন এবং সরবরাহব্যবস্থায়।
চালের জোগানদার রংপুর। অথচ কাগজে খবর আসে, রংপুরের মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তায় ভুগছে। (প্রথম আলো, ৮ নভেম্বর ২০২৪)। এই দায় পূর্ববর্তী সরকার ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের নিতে হবে।
উপদেষ্টার দাবি উঠল কেন
২০১২ সালে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স স্টাডিজ (আইজিএস) ‘দ্য স্টেট অব গভর্নেন্স ইন বাংলাদেশ ২০১২: রিজিয়নস রিপ্রেজেন্টেশন ডিসপ্যারিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, যেখানে মন্ত্রী সেখানে উন্নয়ন বরাদ্দ বেশি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয় গোপালগঞ্জে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই জেলায় মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭৬২ টাকা।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ও তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান তাঁর নিজ জেলা সিলেটকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সিলেটে মাথাপিছু উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৫৮৮ টাকা। অন্যদিকে বিএনপির ওই সময় মন্ত্রীহীন গাইবান্ধায় ওই বছরে মাথাপিছু উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ৬৬০ টাকা।
সংবিধানে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের লক্ষ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত সরকারগুলোর অসম নীতির কারণে রংপুর অঞ্চল পিছিয়ে পড়েছে। এ কারণে অন্তর্বতী সরকারে উত্তরাঞ্চল থেকে উপদেষ্টা নিয়োগের দাবি উঠেছে, যাতে উন্নয়নে সমান অধিকার পায়।
উত্তরাঞ্চল থেকে বিগত মন্ত্রিসভাগুলোতে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাই ‘বঞ্চিত উত্তরাঞ্চলবাসী’ এবার আশা করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে রূপরেখা দেবে। উপদেষ্টা পরিষদে এই অঞ্চলের যিনি বা যাঁরা থাকবেন, তাঁরা গণমানুষের হৃদয়কে ধারণ করে উত্তরাঞ্চলের দাবিনামা সরকারের কাছে তুলে ধরবেন।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা নতুন বাংলাদেশে আর কোনোভাবে বৈষম্য কাম্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহীদ আবু সাঈদের রক্তস্নাত রংপুর—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা দাবি তুলেছে, সুষম উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রণয়নে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ থেকে কমপক্ষে দুজন করে চারজন উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমলা ও কর্মকর্তা নিয়োগে আঞ্চলিক বৈষম্য করা যাবে না।
পুলিশের বুলেটের সামনে আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস উত্তরাঞ্চলের মানুষকে নতুন করে পথ দেখিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শিগগির এই সমস্যার সমাধান করা।
prothom alo