ট্রাম্পের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কি বাড়বে

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে চীনা পণ্যে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কথা বলেছেন ট্রাম্প। তাঁর সেই ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে চীন থেকে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হবে। তার একটা অংশ বাংলাদেশেও আসতে পারে বলে আশা করছেন এ দেশের উদ্যোক্তারা। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বাড়তি ক্রয়াদেশ পেয়েছিলেন। তাতে দেশটিতে রপ্তানিও বাড়ে।

তৈরি পোশাকশিল্পের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নিতে এখনো দুই মাস বাকি। তখন চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়বে কি বাড়বে না, সেটি পরের বিষয়। তবে এখনই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা আগের চেয়ে বেশি ক্রয়াদেশ দেওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছেন। আবার নতুন নতুন ক্রেতা যোগাযোগও শুরু করেছেন। এগুলো ব্যবসায় নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত। যদিও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট এবং ব্যাংকিং সমস্যার সমাধান না হলে ব্যবসা বাড়ানো যাবে না।

প্রথমবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার সময় ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়। এর ফলে ২০১৯ সালে চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরতে থাকে। চীনের হারানো ক্রয়াদেশের একটি অংশ বাংলাদেশও পেয়েছিল। ফলে ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা তার আগের সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। এর মধ্যে করোনার কারণে রপ্তানি কমলেও ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৯৭২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। যদিও পরের বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পোশাক রপ্তানি কমে যায়।

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে পরের পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পোশাক রপ্তানি ১ হাজার ১০৬ কোটি ডলার কমেছে। এই সময় বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ১৮৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৯৬ কোটি ডলার।

দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের পণ্য আমদানি কমাতে যে অস্ত্রটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবেন, তা হলো ট্যারিফ বা শুল্ক। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য আমদানি করে, তার ওপর ১০ বা ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা করছেন তিনি। আর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক হবে ৬০ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ১০০ শতাংশও হতে পারে।

নির্বাচনী প্রচারে গত মাসে শিকাগোতে ইকোনমিক ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, ‘আমার কাছে ডিকশনারির সবচেয়ে সুন্দর শব্দ হলো ট্যারিফ (শুল্ক)। এটি আমার খুব পছন্দের শব্দ।’ ট্রাম্পের এই বাণিজ্যনীতির উদ্দেশ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা।

ক্রয়াদেশ কতটা বাড়বে

গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অবস্থিত এসএম সোর্সিং লিড সনদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানার মর্যাদা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মোট পোশাক রপ্তানির ২৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালের শেষের দিকে ৮০০ শ্রমিক নিয়ে কারখানাটির যাত্রা শুরু।

জানতে চাইলে এসএম সোর্সিং কারখানার স্বত্বাধিকারী মির্জা শামস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছি আমরা। গত কয়েক মাসে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো ব্যবসার পূর্বাভাস পেয়েছি আমরা। এমনকি পোশাকের দামের বিষয়েও কোনো কোনো ক্রেতার কাছ থেকে নমনীয় ভাব দেখা যাচ্ছে।’

বায়িং হাউসগুলো মূলত বিদেশি ব্র্যান্ড ও দেশি কারখানার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। দেশে এক হাজারের মতো সচল বায়িং হাউস আছে। এসব বায়িং হাউসের মাধ্যমেই তৈরি পোশাক রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) পরিচালক ক্য চিন ঠে (ডলি) বলেন, নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কথাবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। ইতিমধ্যে এই বাজারে রপ্তানিকারক চীনা প্রতিষ্ঠান বিকল্প উৎসের সন্ধান করছে। আসলে ব্যাকআপ প্ল্যান করে রাখছে সবাই। এ জন্য বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে তথ্য অনুসন্ধান বেড়েছে। চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরলে ব্যবসা নিতে ভারতও কাজ করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কার পর গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। যদিও প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বড় এই বাজারে চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমলেও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও ভারতের রপ্তানি বাড়ছে।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চীনবিরোধীদের নিয়োগ দিচ্ছেন ট্রাম্প। শেষ পর্যন্ত শুল্ক বাড়ালে চীন থেকে ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হবে। তবে ভিয়েতনামে ইতিমধ্যে সক্ষমতার তুলনায় ক্রয়াদেশ বেশি। তাদের নতুন করে সম্প্রসারণের সুযোগ নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে এখনো কারখানাগুলোতে অব্যবহৃত উৎপাদনসক্ষমতা রয়েছে। এই সুযোগ নিতে হলে গ্যাস-বিদ্যুতের উন্নতির পাশাপাশি ব্যাংকের সহায়তা লাগবে।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীননীতি থেকে সরে আসেননি। ২০২০ সালের আগে চীনের যেসব পণ্যের ওপর শুল্ক বসানো হয়েছিল, বাইডেন সেগুলো বজায় রেখেছিলেন। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারে চীনের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। মূলত দেশি শিল্পকে শক্তিশালী করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য দেশি শিল্পের সক্ষমতা বাড়াবে, মূলত সেসব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াবে। এর ফলে তৈরি পোশাকের ব্যবসা নতুন করে খুব বেশি আসবে বলে মনে হয় না।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে চীনের বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে বার্তা পেয়েছেন। ফলে অনেক বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হবে। আমরা দেশের বর্তমান বিনিয়োগকারীদেরই ঠিকমতো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে অবকাঠামোগত সমস্যা, শ্রম অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করা না গেলে সুযোগ কাজে লাগানো কঠিন হবে।’

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here