কয়েক দিন ধরে দুটি শব্দ দেশে সবার মুখে বেশ নড়াচড়া করছে। একটা হলো ভারত, অন্যটি ইলিশ। ইলিশ নিয়ে কথা বলার আগে ভারত নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। আমাদের এখানে যেকোনো ধরনের আলোচনায় ভারত একটা বড় ফ্যাক্টর, রাজনীতিতে তো বটেই। ভারত না থাকলে আমাদের দেশে রাজনীতি করা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে যেত।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের একটা সাক্ষাৎকার এসেছে প্রথম আলোয়। এই সাক্ষাৎকারে ঘুরেফিরে ভারত প্রসঙ্গ এসেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আসতে জাতীয় পার্টিকে বাধ্য করা হয়েছিল—এ কথা তখনো চাউর হয়েছিল। জি এম কাদের সেটা আবারও পরিষ্কার করলেন। জাতীয় পার্টি দুই দিক থেকে ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হয়েছিল। শেখ হাসিনা ও নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে।
২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে নয়াদিল্লির এত চিন্তা বা শঙ্কা কেন ছিল? সহজেই বোঝা যায় নয়াদিল্লির পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন শেখ হাসিনা। এর কারণ আছে। ভারতের শাসকেরা শেখ হাসিনার মতো একজন শাসককে প্রতিবেশী দেশে দেখে নিরাপদ বোধ করেন। ভারতের মূল নিরাপত্তার শঙ্কা হলো ‘চিকেন নেক’। ছোট্ট এই করিডরটা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করে রেখেছে।
ভারতের শঙ্কার আরেকটা কারণ হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে সীমানা আছে চীনের এবং চীন সেখানে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার দেশের অংশ বলে দাবি করে। চীন ও ভারতের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশদের তৈরি করে দেওয়া সীমান্তরেখা আছে। ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত সেই সীমান্তরেখা চীন মানে না। বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশকে চীন তার অংশ বলে দাবি করে।
উত্তর-পূর্ব ভারতে বেশ কয়েকটি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী আছে, দিল্লি তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে। যা–ই হোক, ভারত রাষ্ট্রের ভেতর থেকে নানা রকম বৈষম্যের শিকার হয়েছে বলে তারা স্বাধীনতা চায়। বিশেষ করে নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসামসহ বিস্তীর্ণ এলাকাতেই এ ধরনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী রয়েছে। এসব অঞ্চলে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত, তা এক বড় প্রশ্ন। কারণ, এ ধরনের ল্যান্ডলক অঞ্চলে কোনো রাষ্ট্রের সীমান্ত সিল করে দেওয়া হলে তাদের না খেয়ে মরার জোগাড় হয়। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সময়ে নেপালের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া তার একটা দৃষ্টান্ত। ২০১৫ সালেও আরেকবার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল ভারত।
যাহোক চিকেন নেক ভারতের সবচেয়ে অস্বস্তির কারণ। সে কারণেই ভারতকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে পারে, এ রকম একটা শাসকগোষ্ঠীকে তারা সব সময় বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চায়। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে তারা সেটা দেখতে চেয়েছে। পঁচাত্তরের পর দিল্লির সেই হিসাবটা পাল্টে গিয়েছিল। যে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা থেকে একাত্তরে তারা বাংলাদেশের বড় অংশীজন হিসেবে এসেছিল, সেটা আর থাকেনি। একপর্যায়ে দিল্লির কাছে মনে হয়েছিল একটা পাকিস্তানই তো ভালো ছিল, এখন দুই দিকে দুইটা পাকিস্তান হলো। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ভারতকে একটা আস্থা ও স্বস্তির জায়গা দিয়েছিলেন, ভারত যা যা চেয়েছিল, তার সবটাই তিনি দিয়েছিলেন।
প্রথমত, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যাপারে কিছু সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী, সংস্থা ছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। দ্বিতীয়ত, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের বড় যে সমস্যা, সেটা সমাধানের জন্য দিল্লি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটা সহজ রাস্তা খুঁজছিল। শেখ হাসিনা ভারতকে সেই সুবিধাটা দিতে চেয়েছিলেন। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে যত সড়ক, সেতু ও রেল অবকাঠামো হয়েছে, তার একটা বড় সুবিধাভোগী হলো ভারত।
শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর ভারত শঙ্কায় আছে। এটা মূলত নিরাপত্তাশঙ্কা। অতীতে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা ততটা উদারভাবে ভারতের চাওয়াগুলো পূরণ করেনি। দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে ভারতের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন নদীগুলো নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে। আমাদের এখানে যে যৌথ নদী কমিশন আছে, সেটা কার্যত কিছু লোকের পুনর্বাসনকেন্দ্র ছাড়া আর কিছু নয়।
চিকেন নেক যেখানে ভারতের জন্য নিরাপত্তার শঙ্কার জায়গা, সেটা আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগের জায়গা হতে পারত। যদি চিকেন নেককে বিবেচনায় নিয়ে আমরা আমাদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি সাজাতে পারতাম, তাহলে সেটা সম্ভব হতো।
আমাদের কার্যত কোনো পররাষ্ট্রনীতি নেই। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে আমরা শুনে আসছি, আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। এটা তো খুব ভাসা ভাসা নীতি আসলে। সবাই তো বন্ধু হয় না। কারণ, এখানে স্বার্থের সংঘাত আছে, ছোট-বড়র দ্বন্দ্ব আছে, ইতিহাসের কিছু পরম্পরা আছে। আমরা এসব বিষয় চিন্তা করে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সাজাতে পারতাম। কিন্তু সেটা আমরা করিনি।
কার্যত আমাদের কোনো প্রতিরক্ষানীতিও নেই। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের কাছ থেকে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে একটা সেনাবাহিনী, একটা নৌবাহিনী ও একটা বিমানবাহিনী পেয়েছি। সেই ধারাবাহিকতা আমরা এখন পর্যন্ত বজায় রেখে চলেছি। আমাদের যদি আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষানীতি তৈরি করতে হয়, তাহলে তার কাঠামো ও অস্ত্রশস্ত্র এক রকম হবে। আর যদি আত্মরক্ষার বাইরে গিয়েও রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখতে হয়, তাহলে আমাদের প্রতিরক্ষানীতি, সশস্ত্র বাহিনীর কাঠামো, অস্ত্রশস্ত্র ভিন্ন হতে হবে। সামরিক বাজেটে আমরা যে বিনিয়োগ করছি, সেটার পেছনে আমাদের কোনো সামরিক-রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে কি না, প্রতিরক্ষানীতিতে সেটা পরিষ্কার নয়।
আমরা এমন একটা সীমান্ত পেয়েছি, যেটার ওপর আমাদের কোনো হাত ছিল না। পেনসিলের খোঁচায় সিরিল র্যাডক্লিপ সেই সীমানাটা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। ফলে আমাদের তিন দিক থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। এ বিষয়টাকে মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে আমাদের দর-কষাকষি করতে হবে, আমাদের প্রতিরক্ষানীতি সাজাতে হবে।
ভারত আমাদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের নীতিটা হচ্ছে আধিপত্যবাদী। একসময় চীনপন্থী কমিউনিস্টরা বলত সম্প্রসারণবাদী নীতি। অনুগত দলকে দিয়ে বিদ্রোহ ঘটিয়ে ভারত একসময় সিকিমকে তার অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সেটা তারা করেছিল অত্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে। কেননা সিকিমের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই চেয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে। কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত নেপালকে বশ করতে পারেনি। ভুটান ভারতের বশে আছে। শ্রীলঙ্কাকে বশে আনতে পারেনি, মালদ্বীপ নিয়ে প্রায় সময়ই টানাপোড়েন তৈরি হয়। আর বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের টানাপোড়েন শুরু থেকেই আছে।
সম্প্রতি ইলিশ নিয়ে যে কাণ্ডটা হলো, সেটা অযৌক্তিক। ইলিশ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টার কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আমরা শুনেছি। প্রথমে বলা হয়েছিল, ‘ভারতকে আমরা ইলিশ দেব না, কারণ আমাদের দেশের লোক ইলিশ খেতে পারে না, তাদের আগে দিতে হবে।’ এটা ছিল একটা জনতুষ্টিবাদী বক্তব্য। বাংলাদেশের মানুষের ইলিশ খেতে পারা না-পারার কিংবা ইলিশের দাম ভারতে রপ্তানির ওপর নির্ভর করে না। কেননা এখানে যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে, তার মাত্র দশমিক ৫০ শতাংশের মতো ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়।
আমাদের অনেক কিছুরই অভাব আছে, তারপরও আমরা রপ্তানি করি। রপ্তানি করি কারণ সেখান থেকে ডলার আসে। বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনীতিকে সব সময় জড়ানো ঠিক নয়। মিয়ানমারের সঙ্গে তো আমাদের অনেক সমস্যা। তাদের সঙ্গে তো বাণিজ্য এক দিনের জন্য বন্ধ হয়নি। যাহোক, শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। ইলিশ–রাজনীতির জায়গায় ইলিশ–কূটনীতি আপাতত বিজয়ী হয়েছে।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
prothom alo