রিজার্ভের এই পতনের ধারা খুবই বিপজ্জনক

মইনুল ইসলাম : ৫ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০.৯০ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এই পতনের ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভ শূন্যেও নেমে আসতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছিল যে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু আইএমএফ সরকারের ওই দাবি মানেনি। তাদের দাবি ছিল, ঘোষিত ওই রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের মাধ্যমে দেওয়া সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, তা-ও বাদ দিতে হবে। আরও বাদ দিতে হবে রিজার্ভ থেকে পায়রা বন্দরের রামনাবাদ চ্যানেল খনন এবং বাংলাদেশ বিমানকে বিমান কেনার জন্য দেওয়া ঋণ।

দীর্ঘ দুই বছর বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আইএমএফের আপত্তির ধার ধারেননি। এখন আইএমএফের ঋণ ৪.৭০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার শর্ত পূরণের উদ্দেশ্যে গত জুলাই মাসে রিজার্ভ হিসাব করার সর্বশেষ পদ্ধতি বিপিএম-৬ মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পুরোনো বিপিএম-৫ পদ্ধতি অনুসরণে যে ‘ইনফ্লেটেড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ’ দেখানোর খামখেয়ালিপনায় পেয়ে বসেছিল, তার ফলে গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করলে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ, পায়রা বন্দরের চ্যানেলের খননকাজ এবং বাংলাদেশ বিমানের বিমান কেনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের ঋণ দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকার কথা নয়।

সেই সাবধানবাণীকে আমলে না নেওয়ার ফলে এখন যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। দেশের ‘নিট রিজার্ভ’ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারের কম এবং প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করতে হচ্ছে। রিজার্ভের এই পতনের ধারাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলতেই হবে।

কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ, হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় আনুষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত আগস্টে আনুষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্স আগের বছরের আগস্টের চেয়ে ২১ শতাংশ কমে গেছে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪.৩৬ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

অথচ কিছুদিন আগেও সরকার উচ্চকণ্ঠে বলেছে, রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই, আমাদের প্রায় ছয় মাসের আমদানি বিল পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। এখন আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রকৃতপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত। আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার শর্ত মোতাবেক ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষে দেশের নিট রিজার্ভকে ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবরেই আমরা এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে সাত বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে আছি।

দেশের দেড় কোটির বেশি মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও তাঁদের অধিকাংশই হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান মিলবে না, কারণ হুন্ডি ডলারের চাহিদাকাঠামো শক্তিশালী থাকলে বাজারে ডলারের দাম যতই থাকুক, হুন্ডি পদ্ধতিতে ডলারের দাম তার চেয়ে সাত-আট টাকা বেশি পাওয়া যাবেই। দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারকারীরাই এই হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে শক্তিশালী রাখছে, যে জন্য দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন দেশের ‘১ নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছে। সংখ্যায় দেশ থেকে পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশি সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের বেশির ভাগের অবস্থান।

অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তাঁরা দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করতে বাধ্য হচ্ছেন, তা বলা যাবে না। এ দেশে তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘এলিট’ গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও আরও বেশি সুখশান্তির আশায় তাঁরা দেশত্যাগে উদ্যোগী হচ্ছেন। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি (উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গার্মেন্টস মালিক), প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক নেতা। তাঁদের বৈশিষ্ট্যগত ‘সাধারণ বৈশিষ্ট্য’ হলো তাঁদের সিংহভাগ ‘কালোটাকার মালিক’, ভালো মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্পকারখানা বা ব্যবসার মালিক হওয়ায় দেশের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

আমার সংবাদপত্রের কলামগুলোতে আমি তাঁদেরকে ‘জাতির ১ নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি। তাঁরা যদি নিজেদের বাপ-দাদার সূত্রে প্রাপ্ত দেশীয় সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রয় করে বিদেশি নাগরিকত্বের আশায় অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় শামিল হন, তাহলে তাঁদের ‘জাতির দুশমন’ আখ্যায়িত করা যৌক্তিক হতো না। অথবা নিজেদের সারা জীবনের বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় থেকে উদ্ভূত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রয় করে যদি কেউ অভিবাসনের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে বিদেশে সপরিবার বসবাসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেন, তাঁকেও গালমন্দ করা সঠিক হবে না।

কিন্তু আমি যাঁদেরকে ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি, তাঁরা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তাঁরা ৫২ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘১ নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে কালোটাকার মালিক হয়ে তাঁদের দুর্নীতিলব্ধ ও লুণ্ঠনকৃত অর্থ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা দুবাইয়ে পাচার করছেন। তাঁরাই কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন।