‘আমি আমার বাঙালি মুসলিম পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করি যারা ত্যাগ ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে একটি সম্প্রদায় গঠন করেছেন। এই সম্প্রদায়ের এই অঞ্চলে একটি ন্যায্য অংশ থাকবে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সত্য হবে। আমি ব্যাকডেটেড জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের নতুন ভাষা ও শব্দবিজ্ঞান দরকার আরও বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য- বাংলাদেশে এবং বাইরে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এসব কথা লিখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাফজুল আলম। শনিবার রাত ৮টায় ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে তিনি আর অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমি কোনো ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলাম না। কিন্তু ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৯ দফাসহ প্রতিটি সিদ্ধান্তে আমার পরামর্শ ও ‘সমর্থন’ ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক মো. মাহফুজ আলমের (মাহফুজ আব্দুল্লাহ) ফেসবুক পোস্টটি এখানে তুলে ধরা হলো-
তিনি লিখেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটা ক্যাম্পেইন চলছে। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া এবং বিএএল-এর (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) প্রোপাগান্ডা সেলে তা হচ্ছে। আমি নাকি হিজবুত তাহরির, জামায়াতের ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি কখনও তাদের রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম না।’
মাহফুজ আলম লেখেন, “ইকোনমিক টাইমসের একজন সাংবাদিক হিজবুত তাহরিরের প্রতি আমার ‘কথিত আনুগত্য’ সম্পর্কে লিখেছেন, যা ভারতীয় রাষ্ট্রের বর্ণনার সেবা ও একীভূত করার জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ইচ্ছাকৃত ফ্রেম করা। আমি হিজবুত তাহরির এবং অন্য কোনো অগণতান্ত্রিক দলের মতাদর্শের বিরুদ্ধে ছিলাম এবং এখনও আছি। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম না। আমি তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরে তাদের প্রোগ্রামে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু আমি বাংলাদেশের জন্য তাদের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। আমি আক্ষরিক অর্থেই জামায়াতের ইসলাম গ্রহণ করিনি এবং এখনও করি না। অতএব, তামিরুল মিল্লাত বা ঢাবি’র অন্যান্য শিবির কর্মীদের মতো ‘লাভ’ বা ‘সুবিধাবঞ্চিত’ হইনি। কিন্তু ক্যাম্পাসে ইসলামোফোবিয়া আর শিবির ট্যাগিংয়ের মুখোমুখি হতে হলো। অতঃপর মুজিববাদ, ইসলামোফোবিয়া, ইসলামবাদী মতাদর্শবিরোধী বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহাসিক আকাঙ্খার বিরুদ্ধে ‘একাকী’ পথ চলতে হলো। পরে, আমি সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক গবেষণা বৃত্তের সঙ্গে জড়িত, যা জুলাই-আগস্টের উত্থানে আমার রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকার পথ সুগম করে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের এ শিক্ষার্থী বলেন, “আমি একজন ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলাম না। কিন্তু ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত ৯ পয়েন্টসহ আমার পরামর্শ এবং ‘সমর্থন’ ছিল।”
তিনি লেখেন, আমি একজন মুমিন এবং একজন বাঙালি মুসলিম। আমি ইসলামবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করি না। এই অঞ্চলে একটি সভ্যরূপে রূপান্তরিত রাষ্ট্র এবং সমবেদনা এবং দায়বদ্ধতা আদর্শের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজের জন্য আমার একটি ভিশন আছে। নিপীড়িত বহুজনের ব্যক্তিগত ও যৌথ আকাঙ্খা রাষ্ট্রের নীতিতে অনুবাদ করার উপায় খুঁজে পাবে। ঢাকা হবে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সভ্যতার মিলন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল। ইনশাআল্লাহ! আমি ইসলামাবাদ বা অন্য কোনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি বিরোধী নই। আমি মনে করি সম্প্রদায় এবং তাদের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি রাষ্ট্র গঠনে একটি সহ-অস্তিত্বীয় স্থান খুঁজে পাওয়া উচিত। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকল্প কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি জন্য জায়গা সীমিত করা উচিত নয়। কিন্তু, এই অভিব্যক্তিগুলোকে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের সঙ্গে এক করা উচিত নয়।
স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমি কঠোর অর্থে লালন ও মার্ক্স অনুসারী নই, তাই ফরহাদ মজহারের ইসলাম ও মার্ক্সবাদ ভার্সনের সদস্যতা করি না। লালনকে আমি বাংলার প্রাণসন্ধানী অনুশীলন ও আচার-আচরণ হিসেবে দেখি। যতক্ষণ না পুঁজিবাদ অব্যাহত থাকবে ততক্ষণ মার্ক্স প্রাসঙ্গিক থাকবে। তবে বাংলা মুসলিমদের প্রশ্ন মূলত নদীমাতৃক ইসলাম ও বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের কাঠামোর মধ্যে উল্লেখ ও আলোচনা করা উচিত। বাঙালি মুসলমানদের উচিত নিকৃষ্টতম জটিলতার বেড়ি ভেঙে তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বচিন্তা বিশ্বজগতে ব্যাখ্যা করা।
তিনি বলেন, আমি কবর বা মাজার পূজারী নই। আমি বিভিন্ন তারিকদের সুফি ও ওলামাদের পূজা করি। কৈশোরে ও পরে অনেক ওলামা ও পীরদের সঙ্গে বসবাস ও যোগাযোগ করেছিলাম। এখনও তাদের সঙ্গে আমার একটি সংযোগ আছে। তারা আমাকে রাসূল (সা.) এর প্রেমে কবুল করেছে। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আবার, আমি আপস করা এবং ফ্যাসিবাদ সক্রিয় করা পছন্দ করি না। আমি ওই সকল সুফি ও আলেমদের ভালোবাসি যারা হকের পক্ষে থাকে (সত্য ও অধিকারের পক্ষে)। আমার মনে হয় এই কবর ধ্বংসকারীরা সত্যিই বাঙালি মুসলিম ও বাংলার সাধারণ আকাঙ্খা ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে।
সবশেষে লিখেছেন, ঐতিহাসিক সম্প্রদায় গঠন হিসেবে বাঙালি মুসলমানদের দক্ষিণ এশিয়ার উপাল্টার্ন (নিপীড়িত হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম) জনতার সঙ্গে জোটবদ্ধ করতে হবে। এইভাবে তাদের মুজিববাদ, ইসলামোফোবিয়া, হিন্দুত্ব এবং ফ্যাসিবাদ দূর করতে হবে যাতে সুফিবাদ ও ইসলামবাদ সক্রিয় করে। আমরা অনেকবারই দেখেছি যে, ফ্যাসিস্টবিরোধী ইসলামও মুজিববাদ ও হিন্দুত্বের জীবনরেখা হয়ে উঠেছে।
samakal
