ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা এখনো রয়ে গেছে উল্লেখ করে তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্র থেকে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, চক্রান্ত হলে দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার সূতি ভিএম পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তারেক রহমান।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টুসহ সব রাজবন্দির মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে উপজেলা ও পৌর বিএনপির উদ্যোগে এ জনসভা হয়।
বিএনপি আগামীতে দেশে উৎপাদন ও উন্নয়নের রাজনীতি চালু করতে চায় বলে জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই জনগণের সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন জনগণের সমর্থন। দেশের জনগণের সমর্থনে তারা সে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলে সেদিনও আপনাদের (টাঙ্গাইলবাসী) সমস্যার কথা তার মনে থাকবে। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম টাঙ্গাইলে বিএনপির এমন জনসভা। এতে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে গোপালপুরের জনসভায় যোগ দেন বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকরা। তাদের ব্যাপক উপস্থিতিতে দুপুর গড়াতেই জনসভা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। প্রায় ১৭ বছর পর গোপালপুরের এই জনসভায় উপস্থিত নেতাকর্মী ও মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তারেক রহমানের বক্তব্য। বিকেল পৌঁনে ৫টার দিকে তিনি জনসভায় ভার্চুয়ালি হাজির হলে হাজার হাজার জনতা তাকে অভিবাদন জানান।
জনসভায় তারেক রহমান বলেন, প্রায় সতের বছর পর আপনাদের সামনে কথা বলছি। কেমন আছেন আপনারা সবাই। প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে আপনাদের সাথে কথা বললেও সব সময়ই আমার মন পড়ে আছে আপনাদের মাঝেই। দেশে থাকতে আপনাদের ভূয়াপুর, গোপালপুরের উপর দিয়ে আমাকে প্রায়ই যেতে হতো দেশের উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার সময়। সুতরাং আপনারা আমার মনের একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছেন। আমি জানি, আজ এখানে শুধু গোপালপুর আর ভূয়াপুরের জনগণই নন- পাশের মধুপুর, ধনবাড়ি, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল সদর ছাড়াও জামালপুর জেলারও অনেকেই উপস্থিত আছেন।
আমার পিতা আপনাদের সবার প্রাণের মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন- কীভাবে দেশের খেটে খাওয়া কৃষক মজুর আর সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে হয়, আর আমার মা আপনাদের সবার প্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাকে শিখিয়েছেন- মানুষের ভালোবাসা অর্জনের গুরুত্ব, শিখিয়েছেন দেশের মা-বোনের সমস্যা সমাধানে কীভাবে কাজ করতে হয়।
প্রায় ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে বেশিরভাগজুড়ে তারেক রহমান টাঙ্গাইল জেলার বিখ্যাত নানা পণ্যের সম্ভাবনা নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, সরকার গঠন করলে টাঙ্গাইলের শাড়ি, চমচম, পাটজাত পণ্য, আনারস ব্যাপক হারে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি হলে দেশ এগিয়ে যাবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমি জানি টাঙ্গাইলের শাড়ি আর চমচমের কথা। যদিও টাঙ্গাইলের শাড়ির সাথে আপনাদের পাশের উপজেলা দেলদুয়ারের নাম সবাই বলে, কিন্তু আমি জানি- এই গোপালপুরেও টাঙ্গাইলের বিখ্যাত শাড়ি তৈরি হয়। এখানকার মা-বোনেরা সূতা রঙ করেন, সেগুলো শুকান আর মাকুতে ভরেন এবং ভাইয়েরা সেটা তাতে লাগিয়ে অসাধারণ সুন্দর শাড়ি তৈরি করেন।
তিনি বলেন, আপনারা তাঁতের কারখানা আরো বাড়ান, দেলদুয়ারের সাথে প্রতিযোগিতা করতে। প্রতিযোগিতা করলে সবারই মান উন্নত হবে। আমাদের গুনগত মান বাড়াতে হবে, ডিজাইনে আনতে হবে বৈচিত্র্য আর সূতি, সিল্ক এবং সূতি সিল্কের সংমিশ্রণেও নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করতে হবে। একদিন আসবে আমরা বিদেশ থেকে শাড়ি আনবো না বরং পৃথিবীর যে সব দেশে মহিলারা শাড়ি পরেন, আর যেখানে বাংলাদেশিরা আছেন সেখানেও অদূর ভবিষতে শাড়ির একাটাই নাম থাকবে টাঙ্গাইল শাড়ি।
তারেক রহমান বলেন, এই এলাকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য পণ্য হলো- চমচম। পৃথিবীর মানুষ জানে চমচম মানেই টাঙ্গাইল আর পোড়াবাড়ি। এখানকার দুধ আর পানি দিয়ে যে চমচম তৈরি হয়, সেটা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কিন্তু এখানেও সমস্যা- নদীতে পানি নেই, দুধের দাম চড়া, আমার গরিব ভাই-বোনদের জন্য দাম সহনীয় নয়। আমরা যদি সুযোগ পাই- দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা যেমন বাড়াব, তেমনি বন্ধ খাল আর নদী আবারও খনন করবো। আর এই চমচম বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে টিনজাত হয়ে পৃথিবীর সব কোনায় পৌঁছে যাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে কয়টি জায়গায় এখনো পাট অন্যতম প্রধান ফসল তারমধ্যে গোপালপুর, ভূয়াপুর উল্লেখযোগ্য। একসময় এখানকার ঝিনাই, ধলেশ্বরী আর বৈরান নদী দিয়ে বড় বড় নৌযান পাট নিয়ে যেত নারায়ণগঞ্জে। আজ বাংলাদেশে পাটের দুর্দশা। এখানেও অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। পাট দিয়ে কেন শুধু বস্তা তৈরি হবে। সারাবিশ্ব আজ পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত, আমাদেরও পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পাটের নতুন নতুন ব্যবহার বাড়াতে হবে, আবিষ্কার করতে হবে। ব্যাগ, বোর্ড, জুতা, স্যান্ডেল, আসাবাবপত্র তৈরির কাজে পাটের ব্যবহার উদ্ভাবন করতে হবে। আর পাটকাঠি দিয়ে শুধু পার্টিকেল বোর্ড নয়, এটারও নতুন নতুন ব্যবহার আবিষ্কার করতে হবে পরিবেশ বাঁচাতে।
তারেক রহমান বলেন, মধুপুরের জলডুবি আনারসের ভক্ত নয় এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটাও একটা মৌসুমী ফল। কিন্তু এটা সংরক্ষণ করতে না পারায় এর বহুবিধ ব্যবহার আজো সম্ভব হয়নি। অথচ পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ নেই যে আনারসের জুস, জ্যাম, জেলি পছন্দ করে না। আমাদের এসব নিয়ে কাজ করতে হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, গোপালপুর আর টাঙ্গাইলের অনেক জায়গায় খুবই উন্নত মানের টুপি তৈরি হয়। রপ্তানিও হয় পৃথিবীর বহু দেশে। মক্কা শরীফের ফুটপাতে আর দোকান থেকে যে টুপি আপনারা কিনে আনেন হজ-ওমরার সময়, সেগুলোর বেশিরভাগই এই টাঙ্গাইলে তৈরি হয়। এর উন্নতি আর বাজারজাত করতে সাহায্য করা দরকার।
তারেক রহমান বলেন, ভূমিহীন মানুষের সংখ্যাও এখানে অনেক বেশি। এসব দিকে নজর দিতে হবে। আর সবার আরেকটি বড় সমস্যা হলো যমুনা নদীর ভাঙন, বিশেষ করে ভূয়াপুর উপজেলায়। এ ব্যাপারে অনেক বাস্তবমুখি আর স্থায়ী পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন গোপালপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস-চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সহসাংগঠনিক সম্পাদক বেনজীর আহমেদ টিটু, সদস্য ওবায়দুল হক নাসির, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন, সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল, জেলা ওলামা দলের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, গোপালপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী লিয়াকত প্রমুখ নেতারা।
kalbela