ফ্যাসিস্ট হাসিনার দানব হয়ে ওঠার সহযোগী-১

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

বিচার বিভাগ

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অধ:পতন আরম্ভ হয়েছিল ২০০৭ সালে এক এগারোর সরকারের আমলে। তখনই বিচার বিভাগে ডিজিএফআই এর কর্তৃত্ব শুরু হয়। আদালতে সেই সময় ডিজিএফআই এর অফিসাররা উপস্হিত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট ও জজদের পরিচালনা করতেন। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করায় যেটুকু রাখঢাক মইন-ফখরুদ্দিনের আমলে ছিল, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ক্ষমতাসীন হয়ে শেখ হাসিনা সেটাও রাখার আর প্রয়োজন বোধ করেন নাই। আমার দেশ পত্রিকা সর্বপ্রথম বিচার বিভাগের ভয়াবহ দলীয়করণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। আজকের তরুণ সেই ইতিহাস জানে না এবং আগস্ট বিপ্লবের সুবিধাভোগীরা গোষ্ঠীস্বার্থে সেই সব কথা ভুলেও মনে করবেন না। ২০১০ সালের ১০ মে আমার দেশে “স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা” শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলাম, “২০০৭ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখে জেনারেল মইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ দেশের বিচার বিভাগে যে পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার আমলে তা দ্রুততর হয়ে এখন সেখান থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ বের হচ্ছে”। সেই লেখার মাশুল আমাকে ডিবি ও র‍্যাবে রিমান্ডে নির্যাতিত এবং দীর্ঘ সময় জেলে থেকে দিতে হয়েছিল।

আমার সেই মন্তব্য প্রতিবেদনের আর একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করছি, “আজকের বাংলাদেশের আদালতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিচারকদের মধ্যকার একটি বৃহৎ গোষ্ঠী ক্ষমতাসীনদের এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে বরং ন্যক্কারজনকভাবে তাদের সক্রিয় সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন”। লেখাটি ২০১০ সালের, আর আজ ২০২৪ সাল। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে আপীল বিভাগের যে আওয়ামী বিচারপতিরা বিতারিত হয়েছেন তারা ২০১০ সালের বিচারপতি নামক দিল্লি ও হাসিনার ক্রীতদাসদেরই উত্তর পুরুষ। আমরা যেন বিজয়ের আতিশয্যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্হাকে কবর দেয়ার সেই সব প্রাথমিক ও প্রধান দানবদের নাম ভুলে না যাই। জীবনের অন্তিম লগ্নে দাঁড়িয়ে বর্তমানে ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে ইতিহাসের দায় মেটাতেই সেই নামগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আজকের সম্পাদকীয়তে লিখে রাখলাম:

১।খায়রুল হক (বিচার বিভাগের প্রধান খলনায়ক এবং গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার হত্যাকারী)

২।এস কে সিনহা (সকল জুডিশিয়াল মার্ডারের প্রধান কুশিলব, চরম দুর্নীতিবাজ, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদের শিষ্য, পরবর্তীতে হাসিনার সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে দেশান্তরী, এবং বর্তমানে ভোল পাল্টানোতে সচেষ্ট)

৩।মোজাম্মেল হোসেন (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং গণতন্ত্র হত্যাকারী)

৪।সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং গণতন্ত্র হত্যাকারী)

৫।হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং গণতন্ত্র হত্যাকারী)

৬।নিজামুল হক (হাসিনার আজ্ঞাবহ, স্কাইপ কেলেংকারির হোতা এবং জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব)

৭।ওবায়দুল হাসান (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব)

৮।এনায়েতুর রহিম (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব)

৯।শামসুদ্দিন চৌধুরী ওরফে মানিক (চরম দুর্নীতিবাজ, হাসিনার আজ্ঞাবহ, জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব, এবং স্যাডিস্ট)

১০।আবদুল মতিন (চরম সুবিধাবাদি এবং প্রধান বিচারপতির পদ না পাওয়ার মন:কষ্টে বর্তমানে সুশীল)

শেখ হাসিনা যে সকল আইনজীবীদের মাধ্যমে উপরের দশ বিচারপতিদের নির্দেশ পাঠাতেন এবং রাজনৈতিক মামলার আগাম রায় সরবরাহ করতেন এবার তাদের তালিকা দিচ্ছি:

১।আনিসুল হক

২।প্রয়াত মাহবুবে আলম

৩।শফিক আহমেদ

৪।প্রয়াত জহিরুল হক ওরফে পিস্তল দুলাল (চরম দুর্নীতিবাজ, সাবেক আইন সচিব)

৫।খুরশিদ আলম (দুদকের আইনজীবী)

৬।মোশাররফ হোসেন ওরফে কাজল (আনিসুল হকের জুনিয়র, দুদকের আইনজীবী, চরম দুর্নীতিবাজ এবং সালমান এফ রহমানের শিষ্য)

৭। এম. আমিন উদ্দিন

৮। প্রয়াত জিয়াদ আল মামুন

৯। গোলাম আরিফ টিপু

১০। রাণা দাসগুপ্ত

হাইকোর্ট এবং ম্যাজিস্ট্রট কোর্ট সম্পর্কে কোন তালিকা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না কারণ, বিগত ষোল বছরে ওই দুই জায়গায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সবাই রক্তপিপাসু দানবের সহযোগী। কম্বল থেকে লোম বাছার চেষ্টা পন্ডশ্রমই হবে। আমার লেখায় যথাসম্ভব ব্যক্তিগত বিষয় আমি এড়িয়ে চলি। আজ হাইকোর্টের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি কেবল ওখানে বিচারপতিদের চেয়ারে যারা বসে আছেন তাদের কুৎসিত আওয়ামী, ফ্যাসিবাদি মানসিকতা জাতিকে অবহিত করবার জন্য।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে কুষ্টিয়ার আদালতে হাসিনার নির্দেশে এবং পুলিশের সহযোগীতায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের জঙ্গী আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম। দুই দিন পরেই আমার সুনামগঞ্জের অপর এক মামলায় নির্ধারিত হাজিরা দেয়া অসম্ভব হওয়ায় মাথায় ব্যান্ডেজ ও গায়ে জ্বর নিয়ে এমবুলেন্সে চড়ে হাইকোর্টে গেলাম। হাইকোর্টের আওয়ামী বিচারপতি চরম ঘৃণা ও প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার চেহারা দেখতে আমাদের ভালো লাগে না। আপনি আজকের পর আর কখনও হাইকোর্টে আসবেন না”। আমি অবশ্যই জানি যে, আমার গায়ের রং খুবই কালো এবং চেহারাও প্রায় কুৎসিতই বলা চলে। কিন্তু, তাই বলে বিচার চাইতেও হাইকোর্টে যেতে পারব না, এ কেমন দেশ, কেমন উচ্চ আদালত? বিচারকদের নাকি ব্যক্তিগত ঘৃণা, বিদ্বেষ থাকতে নেই। সেদিন আমি কিন্তু, হেসেই হাসপাতালে ফিরেছিলাম। সেই ঘটনার একজন স্বাক্ষী ড: ইউনুসের বর্তমান সরকারে আছেন। তিনি হলেন অধিকারের আদিলুর রহমান খান এবং শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা। তিনি সেদিন আইনজীবী হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।তারপরই আমি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি জীবিত থেকে হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে চেয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, একুশ শতকের সবচেয়ে নির্মম শাসকের পতন দেখতে পেয়েছি। হাইকোর্টের সেই বিচারপতি নামধারী নরাধম আজও তো বহাল তবিয়তেই জজগিরি করে চলেছেন! তাহলে বিচার বিভাগের প্রকৃত পরিবর্তন আর হলো কোথায়? দেখা যাক, ড: ইউনুসের সরকার, বিশেষ করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আদালতকে আওয়ামীকরণ মুক্ত করতে সক্ষম হন কিনা।

Amardesh