ঢাকেশ্বরী মন্দিরে জামায়াতের আমির, হিন্দু নেতারা বললেন, কী দোষ করেছি আমরা

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সর্বজনীন পূজা উদ্‌যাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। ঢাকা, ০৮ আগস্ট

জামায়াতে ইসলামীর নাম-ব্যানার ব্যবহার করে কেউ দুর্বৃত্তপনা করলে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের অনুরোধ করেছেন দলটির আমির শফিকুর রহমান। হামলা ও লুটপাটের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তাঁরা যেন সাহস করে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলেন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে সর্বজনীন পূজা উদ্‌যাপন কমিটির নেতাদের এ কথাগুলো বলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। তিনি বলেন, ‘খুব পরিষ্কার করে বলছি, বাংলাদেশের কোনো জায়গায় জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যারা কাজ করে, যদি কোথাও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে কোনো অপকর্ম করছে, তাহলে সে একজন দুর্বৃত্ত। কথা দিচ্ছি, আমরা কোনো দুর্বৃত্তকে তো প্রশ্রয় দেবই না, এ অপকর্মের জন্য আমরা তার পাওনা বুঝিয়ে দেব।’

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার থেকে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরে পালাক্রমে পাহারা দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ সকালে শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতের একদল নেতা ঢাকেশ্বরীতে যান। ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার রায়সহ নেতারা জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর, সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার রায়, ঢাকেশ্বরী মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি চিত্তরঞ্জন মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক দীপেন চ্যাটার্জি, মহানগর পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস পাল, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক প্রমুখ।

জয়ন্ত কুমার রায় জামায়াত নেতাদের সামনে প্রশ্ন তোলেন, যখন সরকার পরিবর্তন হয়, তখন তাদের (হিন্দু সম্প্রদায়) ওপর অত্যাচার কেন? এ পর্যায়ে জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘নবীজি যখন বিদায় হজে ভাষণ দিয়েছিলেন, কী বলেছিলেন। “তিনিই প্রকৃত মানুষ, যে তোমার পার্শ্ববর্তী মানুষকে রক্ষা করে। সেই হলো প্রকৃত মানুষ, সেই হলো ইমানদার।” কিন্তু আমরা কী দেখতে পাই। এই ছাত্র-জনতার মধ্যে কি আমাদের হিন্দু ভাই-বোনেরা মরে নাই? আমাদের কি কোনো অবদান নাই? তাহলে মন্দির পোড়ে কেন? আমার ব্যবসা লুটপাট হয় কেন? আমার মা-বোনের ইজ্জত যায় কেন? আপনারা বলেন দুর্বৃত্ত, কিন্তু নামটা হয় আপনাদের। সবাই বলে জামায়াতে ইসলামীর কথা।’

তখন পাশে বসা জামায়াতের আমির বলেন, যত দোষ নন্দ ঘোষ। তখন জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘ওই যে আমির সাহেব বলেছেন। আমরাও কিন্তু খবর নিই, কে নিছেন না নিছেন। আমরা কেন এখানে সবাই উপস্থিত হয়েছি। আরও আসার কথা। আমি বলেছি, আসার দরকার নেই।’

হিন্দু সম্প্রদায়ের এই নেতা আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আজকে উনি যে বক্তব্যটা রাখলেন, ওনার বাড়িও কিন্তু শাহজালাল বাবার (সিলেটে হজরত শাহজালাল রহ. দরগাহ) দেশে। যা বোঝেন ভালো বোঝেন, যা বোঝেন না ভালো বোঝেন না। ডানে যে একজন (সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের) আছেন, তিনি দুই দিন আগে জেল থেকে বের হয়েছেন। সুতরাং বলার কিছু নেই। আপনারাও বোঝেন আমরাও বুঝি। এই যে উনি বলেছেন দেশে এখন সরকার নেই।…কোথায় আছি আমরা। দেশ যাচ্ছে কোন দিকে।’

জামায়াত আমিরের দিকে ইঙ্গিত করে জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘আপনি এসেছেন একটা বার্তা যাবে সারা বাংলাদেশে, বিশ্বে। আমরা সেই বার্তাটাই চাই। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমরাও কিন্তু রাস্তায় নামব। কেন আমাদের ওপর এত অত্যাচার?’

এ সময় জামায়াত আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘সবাই আমরা একসঙ্গে নামব।’

আক্ষেপ প্রকাশ করে জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘কী দোষ করেছি আমরা? মনের কথাটা বলতে পারি না। অনেক কথা আছে। শেষ কথা হলো আমরাও মানুষ।’

এ প্রসঙ্গে নিজের বাড়ি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে সংঘটিত একটি ঘটনা উল্লেখ করেন জয়ন্ত কুমার। তিনি জানান, গতকাল বুধবার আজমিরীগঞ্জে এক হিন্দু বাড়িতে গিয়ে দেড় লাখ টাকা পান দাবি করে একজনকে কুপিয়ে আহত করেন এক ব্যক্তি। পরে এলাকার এক ভাইকে জানিয়ে তাঁর লোকদের থামানোর অনুরোধ জানান তিনি।

শফিকুর রহমানের দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘আপনি আছেন, আপনি শীর্ষ পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। আমরা সেই দিন শুনেছি, সামরিক বাহিনীর প্রধান এখানে কে কে উপস্থিত, প্রথমেই বলেছেন জামায়াতের আমির। এটা নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে। সুতরাং বলার কিছু নেই। এই মেসেজ পৌঁছে দেবেন, এই দেশ আপনার, আমার—সবার। আপদে-বিপদে আমরা সবাই পাশাপাশি থাকব।’

এ সময় জামায়াতের আমির বলেন, ‘আপনারা আমাদের কাছে যা প্রত্যাশা করেছিলেন, তা পাচ্ছেন কি না।’

‘পাচ্ছি’ বলে জবাব দেন একজন।

এ পর্যায়ে জামায়াতের আমির বলেন, ‘তাহলে মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী সাক্ষী হয়ে গেল। আমরা আসলে কাউকে সাক্ষী করার জন্য আসিনি, বাহবা নেওয়ার জন্য, রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য করিনি। মানুষ হিসেবে মানুষের কাজ করার জন্য আমরা এটা করেছি। আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাইতে এসেছি বিশেষভাবে পরিস্থিতিতে একটা ব্যাপারে। আপনারা যদি আমাদের কখনো ফিল করেন, এটা হবে আমাদের জন্য আপনাদের উপহার।’

জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে দলের কেউ কোনো অপকর্ম করলে সে-ও একজন দুর্বৃত্ত।’

শফিকুর রহমান বলেন, ‘এ রকম কিছু হলে আপনারা আমাদের নির্দিষ্টভাবে বলবেন এবং তাকে আমরা কী করি, সেটাও জানবেন। আমাদের নামে কে কী বলল, সেটা আমরা বদার করি না। আমরা বদার করি, আমাদের বিবেককে। বিবেক কী সাক্ষী দিচ্ছে, আমি সঠিক পথে আছি না বেঠিক পথে। যদি সঠিক পথে থাকি, তাহলে পরিবেশও সাক্ষী দেবে, মানুষও সাক্ষী দেবে।’

prothom alo