শেখ হাসিনার ভাষণ কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে পারেনি কেন?

আকবর হোসেন, বিবিসি নিউজ বাংলা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার যখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন সকলেরই দৃষ্টি ছিল তিনি কী বলবেন? সরকার কোন পথে হাঁটবে সেদিকেই ছিল সবার নজর। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীরা কিভাবে গ্রহণ করবে?

এই ভাষণের পর আন্দোলনকারীদের দিক থেকে সেটি প্রত্যাখ্যান করতে খুব বেশি সময় নেয়া হয়নি। এই ভাষণের পর কোটা-বিরোধীরা ‘কমপ্লিট শাট-ডাউনের’ ডাক দেয়। রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়।

একদিকে কোটা-বিরোধীরা রাস্তায় নামে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন রাস্তায় নেমেছিল। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একে একে নিহত হবার খবর আসতে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর সংঘাত আরো ছড়িয়েছে।

আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আদালতের মাধ্যমে তারা ‘ন্যায়বিচার’ পাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। বিচারবিভাগের ওপর আস্থা রাখার অনুরোধও করেন তিনি।

“এ ধরণের পরিস্থিতিতে একজন টিপিকাল সরকার প্রধান তার রেজিমের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য যা বলেন, তিনি সেটাই বলেছেন। মূল সমস্যা সমাধানে তিনি কিছু বলেননি,” বলছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ।

সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রাবাস খালি করার পরও প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের চিত্র বদলায়নি।

কিন্তু কোটা বিরোধীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে তারা যা ‘প্রত্যাশা’ করেছিলেন সেটি তারা পাননি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কোটা-বিরোধীরা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাস্তায় নেমে আসে।

এ রকম একটি জায়গা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি ইসিবি চত্বর এলাকা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তত কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ইসিবি চত্বর অবরোধ করে রেখেছে। সেখানে কথা বলছিলাম কয়েকজন আন্দোলনকারীর সাথে।

এ সময় তারা কোটা সংস্কারের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকে। এসময় শিক্ষার্থীরা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

বুধবার প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেয়া আলিম খান বিবিসি বাংলাকে জানান, প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছেন তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই ভাষণে তিনি কোটা বাতিল হবে এমন কোন ঘোষণা দেননি।

আলিম খান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী একদিকে বলছেন শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকতে, অন্যদিকে পুলিশ, বিজিবি, ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এটা সরকারের ডবল স্ট্যান্ডার্ড।”

প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের মুখে বৃহস্পতিবার দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কোটা সংস্কারের পক্ষে সরকার নীতিগতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। মন্ত্রী বলেছেন, কোটা সংস্কার ইস্যুতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আজকেই আলোচনায় বসতে রাজি সরকার।

কারফিউ জারি করতে হলো কেন?

কারফিউ এমন এক সময়ে জারি করা হলো যখন পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবির সাথে বিক্ষোভকারীদের রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছে টানা চারদিন ধরে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে?

“এক অর্থে তো হয়েছেই। যেখানে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন দখল করলো দুষ্কৃতিকারীরা। পুলিশ, বিজিবি সেটা ঠেকাতে পারলো না। এটা তো বড় ধরনের ব্যত্যয় বলে আমি মনে করি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সাবেক পুলিশ প্রধান একেএম শহিদুল হক।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মনে করছেন, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়নি। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, চলমান সহিংসতা থামানো এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করার জন্য সরকার কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে।

“সেজন্যই বলা হয়েছে ইন এইড অব সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায়)। তারা মোটেও ব্যর্থ হয় নাই। আমাদের কথা হচ্ছে, যেভাবে তারা কেপিআইগুলো (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) ধ্বংস করেছে এবং জনগণের ট্যাক্স-এর টাকায় যেসব স্থাপনা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য করা হয়েছে, সেগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য আমরা এটা (কারফিউ) দিতে বাধ্য হয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আইনমন্ত্রী।

আইনমন্ত্রী বলছেন, যারা কোটা বিরোধী আন্দোলন করছে তারা এই সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত নয়। তারা এটা পরিষ্কারভাবে এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে যে এটা কিছু রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা তাদের নেতাদের উস্কানিতে করছে।

“সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এবং জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য যেটা করার দরকার আমরা সেটা করেছি। আমরা আশা করছি কারফিউ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো,” বলেন আইনমন্ত্রী।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, গত কয়েকদিনের সংঘাতের কারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে।

“এতো পুলিশ, এতো র‍্যাব, এতো বিজিবি – সব নামানোর পরেও সরকার যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সেজন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি,” বলেন তিনি।

Source: BBC Bangla