চাপের কারণেই খেলাপি ঋণের আসল তথ্য বেরিয়ে আসছে

চাপের কারণেই খেলাপি ঋণের আসল তথ্য বেরিয়ে আসছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ব্যাংকগুলোকে চাপে রাখার কারণেই খেলাপি ঋণের আসল তথ্য বেরিয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় প্রকৃত তথ্য সামনে আসুক। রপ্তানিও আর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হবে না। আগামীতে আসল তথ্য পাওয়া যাবে।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের আগে গতকাল বুধবার স্টেকহোল্ডার বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে গত ৬ জুন প্রথম প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়ে মার্চ শেষে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এক বছর আগের তুলনায় তা ৫০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা বেশি। আবার গত সপ্তাহে রপ্তানির প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে এপ্রিল মাসের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি বেশি দেখানো হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর গত দশ বছরে বেশি দেখানো হয় প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলার। এসব নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। এ ছাড়া গত ২ জুলাই সমকালে প্রকাশিত ‘নিয়ম না মেনে চার গ্রুপের ৬৪৯৭ কোটির সুদ মওকুফ’ শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।

বৈঠকে আব্দুর রউফ বলেন, চার গ্রুপের সুদ মওকুফের ঘটনা বেশ আগের। ওই সময় এসব নিয়ে রিপোর্ট হয়নি। এখন হঠাৎ করে কেন সামনে এলো তিনি বুঝতে পারছেন না। এখন অনেকেই মনে করছে তার সময়ে এটা হয়েছে। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তিনি। রপ্তানির তথ্যে পার্থক্য বিষয়ে বলেন, তিনি গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর দেখলেন ইপিবির তথ্যের সঙ্গে মূল্য প্রত্যাবাসনে অনেক পার্থক্য। এরপর ব্যবসায়ীদের তিনি বলেছিলেন, আপনারা বাইরে টাকা রেখে আসছেন। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তিনি অভিযোগ করেন– ব্যবসায়ীদের এত এত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে আর তারা বাইরে অর্থ রেখে আসছেন। অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলে আসছিলেন, এই রপ্তানি তাদের না। এত রপ্তানি কোথা থেকে আসছে তারা জানেন না।

গভর্নর বলেন, আগামীতে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ইপিবি, ট্যারিফ কমিশন মিলে তথ্য সংশোধনের ফলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। সেখানে কম হলেও সেটা তো খারাপ কিছু না। খালি খালি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে তো কোনো লাভ নেই।

একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে বৈঠকে আলোচনার পর গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলোকে চাপে রাখার কারণেই খেলাপি ঋণের আসল তথ্য বেরিয়ে আসছে। আগে এক সময় উইন্ডো ড্রেসিং করা হতো। আমরা সেটা চাই না, আমরা চাই প্রকৃত তথ্য সামনে আসুক। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের নিয়েও কাজ হচ্ছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য এরই মধ্যে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গভর্নর বলেন, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে ভালো সমন্বয় আছে। এ কারণে প্রকৃত অর্থে বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। সবাই আলোচনা করে একমত হয়ে এটা করেছেন। অর্থায়নের সমস্যা তুলে ধরে গভর্নর বলেন, বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আসে পুঁজিবাজার থেকে। আর চলতি মূলধন ঋণ দেয় ব্যাংক। বাংলাদেশে দুটিই হচ্ছে ব্যাংক থেকে। ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করে। এটাই এখানকার ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি দুর্বলতা বা ব্যাংকের সদিচ্ছা নিয়ে যতই দোষ চাপানো হোক এটাই মূল সমস্যা। এটা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ নিতে বলা হচ্ছে। তবে এ জন্য একটু সময় লাগবে।

আগামী ১৮ জুলাই প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন ধার্য করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে মতামতের জন্য গতকালের বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও কয়েকটি ব্যাংকের এমডি উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। বৈঠকে ব্যাংক খাতের তদারকি জোরদার, মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরামর্শ উঠে আসে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানার লক্ষ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য গত জানুয়ারিতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়।

এর আগে, সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্রলিং পেগ নামে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহারের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

samakal