ঋণফাঁদে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ

  • মাসুম খলিলী

বাংলাদেশের বাজেট বাস্তবায়নে দেশী-বিদেশী ঋণনির্ভরতা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে ঋণফাঁদে আটকে পড়ার আশঙ্কা। সরকারের নেয়া ও গ্যারান্টি দেয়া ঋণের নিরাপদ হার জিডিপির ৪০ শতাংশের কাছাকাছি এসে গেছে এর মধ্যে। আগামী বছরগুলোতে এই হার নিম্নমুখী হওয়ার প্রক্ষেপণ সরকারের বাজেট ডকুমেন্টে করা হলেও বাস্তবতা এর উল্টো। এমনকি আইএমএফ গত বছর বাংলাদেশ বাহ্যিক ও সার্বিক ঋণ সঙ্কটের কম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করলেও এখনকার প্রবণতা তেমনটি আর নেই। ফলে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মধ্যমেয়াদে নিরাপদ সীমা অতিক্রম করতে পারে।

বাংলাদেশের ঋণ বহন করার ক্ষমতার টেকসই বিশ্লেষণে (ডিএসএ) স্পষ্টতই এখন দেখা যাচ্ছে, ঋণ আর রফতানি অনুপাতের বর্তমান মান বাহ্যিক ঋণের স্থায়িত্ব সূচকের থ্রেশোল্ড অতিক্রম করেছে। নিকট-মেয়াদে বর্ধিত বিদেশী ঋণের প্রক্ষেপণে অনুকূল ঋণের গতিশীলতায় সরকার ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশী ঋণ আর জিডিপি অনুপাত মাঝারি মেয়াদে আরো নেতিবাচক হবে বলেই মনে হচ্ছে। একদিকে ঝুঁকিগুলো নেতিবাচক দিকে ঝুঁকছে আর এর মধ্যে ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান সুদের বোঝা, রাজস্ব সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা, প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে মন্থরতা, জটিল সামষ্টিক কাঠামোগত সংস্কারের ধীর বাস্তবায়ন, পরিবর্ধিত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের চাপ, ক্রমবর্ধমান অকার্যকর ঋণ (এনপিএল) ও জলবায়ু সম্পর্কিত ঘটনা সে ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

পটভূমি ও উন্নয়ন
বাংলাদেশে মোট সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ (পিপিজি) ২০২৩ অর্থবছরে ১৬৬.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়, যা দেশজ উৎপাদন-জিডিপির অনুপাতে প্রায় ৩৯.৮ শতাংশ। ২০২৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ পিপিজি ঋণ ছিল মোট ঋণের ৫৫.৬ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিষেবা প্রদানের অঙ্ক ছিল ৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা জিডিপির ১.৯ শতাংশ এবং প্রস্তাবিত বাজেটের ১৩ শতাংশের মতো। অন্যদিকে এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণে পিপিজি ঋণ ছিল মোট ঋণের ৪৪.৪ শতাংশ। আর এই ২০২৩ অর্থবছরে বিদেশী ঋণ পরিষেবা প্রদান করতে হয় ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা জিডিপির ০.৫ শতাংশ। এর মধ্যে, প্যারিস ক্লাব এবং নন-প্যারিস ক্লাব ঋণদাতাদের ঋণ পরিষেবা প্রদানের পরিমাণ যথাক্রমে ০.৫ বিলিয়ন ও ০.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ পশ্চিমা ও অপশ্চিমা ঋণের অনুপাত প্রায় কাছাকাছি।

ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে রাখার বিষয়ে সরকার সচেষ্ট বলে বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই উন্নয়ন বাজেটের প্রায় পুরোটা দেশী-বিদেশী ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে বলে দেখানো হয়েছে। গত তিন দশকের বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো এটি করা হয়েছে। বাজেট দলিলে বলা হয়েছে, সরকারের কৌশলের একটি বিশেষ দিক হলো সুশৃঙ্খল আর্থিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, পুঁজিবাজার গভীরতা বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুসংহত করতে সরকারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা। বাস্তব অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সাথে সরকারের এই বিবৃত কৌশলের কোনো মিল দেখা যাচ্ছে না।

বাজেট দলিলে ২০২১-২২ থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছর নাগাদ বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের গতিধারা ও মধ্যমেয়াদি পূর্বাভাসে সরকারি ঋণ বৃদ্ধির চিত্রই পাওয়া যায়। এই চিত্র অনুসারে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে নিট অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১,৮৩১.২ বিলিয়ন টাকা যা ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৩,০৩৯ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হবে। তবে নিট অর্থায়ন ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির ৪.৬ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে জিডিপির ৪.৪ শতাংশ হবে মর্মে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। বাস্তবতা অনুযায়ী সরকারের নিট অর্থায়ন প্রক্ষেপণ অনুসারে কোনোভাবে কমানো যাবে না। কারণ মধ্যমেয়াদে বাজেট ঘাটতি হ্রাসের ফলে সরকারি ব্যয় কমার সম্ভাবনা কিছুটা থাকলেও বর্ধিত বিদেশী দায় মেটাতে অতিরিক্ত অর্থায়নের কোনো বিকল্প থাকবে না।

বিস্ময়করভাবে বাড়ছে সুদব্যয়
মধ্যমেয়াদে সরকারের প্রাক্কলিত সুদব্যয় এ খাতে সরকারের ক্রমবর্ধমান ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতাই নির্দেশ করে। সুদ পরিশোধের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের সুদব্যয় ৭৭৭.৭ বিলিয়ন টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ১,৫৪৫ বিলিয়ন টাকা হতে পারে। এতে সুদব্যয় ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের ১৫.৩ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২.৪ শতাংশে হ্রাস পেয়ে তা ২০২৬-২৭ অর্থবছরে পুনরায় ১৫.৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারে বলে নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, মোট সুদব্যয়ে বৈদেশিক সুদের অংশ কম হলেও বৈদেশিক সুদের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছরের ৪৫.৬ বিলিয়ন টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২৬০ বিলিয়ন টাকা হতে পারে। মোট বাজেটে বৈদেশিক সুদের অনুপাতও ২০২১-২২ অর্থবছরের ০.৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২.৬ শতাংশ হতে পারে বলে নীতি বিবৃতিতে অনুমান করা হয়েছে। আর বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই লক্ষণীয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক অর্থায়নের অংশ ৪০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদব্যয় বৈদেশিক ঋণের সুদব্যয়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। এর কারণ হলো- বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে থেকে প্রাপ্ত নমনীয় শর্তের ঋণ আর অভ্যন্তরীণ ঋণের বেশির ভাগ বাজারভিত্তিক সুদহারের ভিত্তিতে নেয়া। তবে উন্নত দেশগুলোতে ২০২২ সাল থেকে সঙ্কোচনমূলক কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করায় বিদেশী ঋণের উপর সুদব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত দু’টি কারণে মধ্যমেয়াদে বিদেশী ঋণের উপর সুদব্যয় মোট ব্যয়ের ২ শতাংশের উপরে থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রথমত, উন্নত দেশগুলোর রেফারেন্স সুদহার নিকট ভবিষ্যতেও উচ্চ থাকবে এবং দ্বিতীয়ত স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক উৎস থেকে অনুদান ও নমনীয় শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হবে।

মূলত দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং এই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতির কারণে অভ্যন্তরীণ ঋণের উপর অন্তর্নিহিত সুদের হার ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উচ্চ থাকবে যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯.১ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৯.৬ শতাংশ হতে পারে। বাজেট দলিলে মধ্যমেয়াদে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে আশা করা হলেও টাকার অব্যাহত অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের কারণে বাস্তবে সেটি হবে বলে মনে হয় না।

অন্যদিকে ফ্লোটিং ও আংশিক নমনীয় সুদে উচ্চ অঙ্কের ঋণ নেয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণের অন্তর্নিহিত সুদের হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক ঋণের অন্তর্নিহিত সুদের হার ২০২১-২২ অর্থবছরের ১ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২.৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের ঋণস্থিতির তথ্য পর্যালোচনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি বৈদেশিক ঋণস্থিতিকে অতিক্রম করার চিত্র ফুটে ওঠে। প্রাথমিকভাবে জিডিপির শতাংশ হিসাবে মোট ঋণের নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা যায় যা ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৩৫.৯ শতাংশ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬.২ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু পরবর্তীতে ঋণ- জিডিপি অনুপাতের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৩৬ শতাংশে পৌঁছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এটি ৩৭.৬৯ এবং ২০২৪-২৫ বছরের মূল বাজেটে ৩৮.৬ শতাংশে উন্নীত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জিডিপির শতাংশ হিসাবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে যা ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ১২.৬ শতাংশ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ শতাংশে পৌঁছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটি ২৩ শতাংশের ওপরে প্রাক্কলন করা হয়েছে। অন্যদিকে, জিডিপির শতাংশ হিসাবে বৈদেশিক ঋণ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ২৩.৪ শতাংশ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০.১ শতাংশে নেমে আসার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার ১৫.০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নতুন অর্থবছরের জন্য সেটি সাড়ে ১৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণের এই বৃদ্ধির জন্য টাকার অবমূল্যায়নকে দায়ী করা যেতে পারে। ঋণের স্থিতি স্থানীয় মুদ্রায় প্রদর্শনে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। অবমূল্যায়নের এই ধারা মধ্যমেয়াদে অব্যাহত থাকবে আর তাতে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত আরো বাড়বে। সামগ্রিকভাবে, মোট ঋণে অভ্যন্তরীণ ঋণের হিস্যা বৃদ্ধি পেলেও বৈদেশিক ঋণের ওপর মুদ্রা বিনিময় হারের প্রভাব বিবেচনায় বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যাচ্ছে।

মধ্যমেয়াদি প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, সরকারি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০২১-২২ অর্থবছরের ৩৩.৮ শতাংশ থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩৯.৪ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। সরকারের প্রক্ষেপিত বাজেট ঘাটতি পূরণে মধ্যমেয়াদে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে যে ঋণ গ্রহণ করা হবে তা এই বৃদ্ধির জন্য দায়ী। অভ্যন্তরীণ ঋণ ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির ২১ শতাংশ থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে জিডিপির ২৪ শতাংশে উন্নীত হতে পারে, যার ফলে তা মোট ঋণের ৬৩.১ শতাংশ থেকে ৬২.২ শতাংশে হ্রাস পাবে। অন্যদিকে, জিডিপির অংশ হিসাবে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১২ শতাংশ থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ১৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সরকার সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পরও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

ব্যয়বহুল ঋণের ফাঁদ
বৈদেশিক ঋণের দায় পরিশোধ বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। দেশের নমনীয় এবং আধা-নমনীয়- উভয় ধরনের বৈদেশিক ঋণই রয়েছে, যার প্রতিটির মেয়াদ এবং শর্ত ভিন্ন ভিন্ন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল বাবদ ১,৭৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী যার পরিমাণ দাঁড়াবে ২,৪৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মধ্যমেয়াদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ হবে ২,৬২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২৫-২৬ অর্থবছর ২,৭২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের মধ্যে ৩,১৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পেতে পারে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও, তা সহনীয় সীমার মধ্যে রাখতে সরকার বৈদেশিক অর্থায়ন উৎসের বিকল্প অনুসন্ধান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে সচেষ্ট রয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

বৈদেশিক ঋণের কারেন্সি মিক্সে বৈচিত্র্য এনে চাপ কমানোর কথা বলা হচ্ছে। ঋণের কারেন্সি মিক্স চিত্রে দেখা যায়, এতে মার্কিন ডলারের অংশ রয়েছে সর্বাধিক ৫৩ শতাংশ, জাপানি ইয়েন রয়েছে ২০ শতাংশ, ইউরো ১৫ শতাংশ, চাইনিজ আরএমবি ৮ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ড ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য মুদ্রা ১ শতাংশ। এটি ঋণস্থিতিতে মুদ্রার বিচিত্রতা নিশ্চিত করলেও বাস্তবে ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের সাথে প্রতিটি মুদ্রার বিনিময় হার একই অনুপাতে বাড়তে দেখা যায়। ফলে এখান থেকে খুব বড় কোনো প্রতিকার বাস্তবে মিলবে না।

বিভিন্ন রষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি প্রদান করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সরকারের বিভিন্ন পলিসি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি প্রধানত দেয়া হয় বিভিন্ন সংস্থাকে বেসামরিক বিমান চলাচল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ইত্যাদি খাতে। চুক্তিকারী সংস্থা যদি সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গ্যারান্টিকৃত ঋণের অর্থ পরিশোধের দায় সরকারের উপর বর্তায়। ফলে এ গ্যারান্টিগুলো শেষ পর্যন্ত সরাসরি সরকারি দায়ে পরিণত হতে পারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির বিপরীতে গৃহীত ঋণের পরিমাণ ৯৮৫.৯১ বিলিয়ন টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৯২৬.০২ বিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির বিপরীতে গৃহীত কোনো ঋণ এ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়নি, তবে সে আশঙ্কা রয়েছে মধ্যমেয়াদে।

বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকির বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আয় ও ব্যয় প্রাক্কলন বেশির ভাগ সময় অতিমূল্যায়িত হয়ে থাকে। এ ধরনের অতিমূল্যায়নের যে ঝুঁকি তৈরি হয় তা হলো, যদি সরকারি ব্যয় কোনো বছরে প্রাক্কলনের সমান হয়ে যায় এবং রাজস্ব আয় সে পরিমাণে না বাড়ে তাহলে সরকারকে আকস্মিক ও অপরিকল্পিত বাজেট ঘাটতির মোকাবেলা করতে হয়।

কৌশলগত টানাপড়েন
দেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা প্রকট হলে দেশী-বিদেশী ঋণফাঁদে পড়তে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা সে পরিস্থিতির মধ্যে গেছে। বেহিসাবি ঋণ নেয়ার ফলে দেখা গেছে, দেশটির রাজস্ব আয়ের ৯০ শতাংশ সুদ পরিশোধে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত বাজেট অনুসারে রাজস্ব আয়ের পুরোটা সরকারের পরিচালন ব্যয় নির্বাহে চলে যাবে। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে ধার করে, যে অবস্থা এরশাদ আমলে একবার দেখা গিয়েছিল।

বাজেটের আয়-ব্যয়ের এই ভারসাম্যহীন চিত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারের বৈদেশিক সম্পর্কের কৌশলগত টানাপড়েন। প্রতিবেশী ভারত থেকে চাপ আসছে চীনা অর্থায়নে তাদের জন্য সংবেদনশীল কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার। আর চীনা সহায়তা ছাড়া বৈদেশিক খাতে এখন যে চাপ তা মোকাবেলা করার কোনো পথ থাকছে না ঢাকার জন্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে গত ডিসেম্বর নাগাদ। শুধু তিন মাসে চার বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বিদেশী ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই ঋণের বড় উৎস হলো চীন। পুঞ্জীভূত বিদেশী ঋণ চিত্রে চীনের ঋণের অংশ ৯ শতাংশ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে চীনা ঋণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

সরকার আশা করছে, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার প্রেক্ষিতে চীন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বাজেটসহায়তা পাওয়া যাবে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে প্রকল্প সাহায্য পাওয়া যাবে ২৬ বিলিয়ন ডলার। আর এ দিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট সামাল দেয়া যাবে। কিন্তু দিল্লির পক্ষ থেকে এই অর্থ না নিয়ে জাপান বা বিশ্বব্যাংকের মতো বিকল্প উৎস থেকে ঋণ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বেসরকারি ঋণের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ এসেছে চীন থেকে। এই প্রবাহ দিল্লির চাপের কারণে বন্ধ হলে তাৎক্ষণিক বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণ করা কঠিন।

এর ফলে বাংলাদেশের একদিকে ব্যয়বহুল বিদেশী ঋণ ঋণফাঁদে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে শ্রীলঙ্কার মতো বৈশ্বিক খেলাপি হওয়ার ভয়। এর মধ্যে বৈদেশিক সম্পর্কের টানাপড়েন এক জটিল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে দেশ ও সরকারকে। এবারের বাজেটের সুপ্ত বাস্তবতা পাঠ করলে সেটি স্পষ্ট হবে অনেকখানি।

NAYADIGANTA