ইসির হিসাবেই ভোটে গরমিল

ইসির হিসাবেই ভোটে গরমিল

ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বেধেছে গোলযোগ। খোদ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হিসাবেই গণনার আগে ও পরে প্রায় ১০ শতাংশ ভোটার বেড়ে যাচ্ছে। ঠিক থাকছে না চেয়ারম্যান পদের সঙ্গে অন্য পদে পড়া ভোটের সংখ্যাও। ফলে ২১ কোটি টাকার অ্যাপস নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। দুই ঘণ্টা পর পর সঠিক ভোটের হার নিশ্চিত করে সবাইকে জানাতে অ্যাপসটি তৈরি করেছে ইসি।

মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞ নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, ভোট গণনার আগে ও পরে উপস্থিতির হারে তারতম্য অস্বাভাবিক। আবার একই উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে পড়া ভোটের তারতম্যের অর্থ অনিয়ম হয়েছে।

সমকালের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দ্বিতীয় ধাপে ভোট শেষে বিকেল ৪টায় ময়মনসিংহের তিন উপজেলা থেকে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে ভোটের হার সদরে ২৭, মুক্তাগাছায় ২৫ ও গৌরীপুরে ৩০ শতাংশ উল্লেখ করা হয়। সকাল ৮টা থেকে দুই ঘণ্টা পর পর ভোটার উপস্থিতির হিসাব রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে পাঠানো হয়। ইসির অ্যাপসের মাধ্যমেও এসব তথ্য আপডেট করা হয়। কিন্তু গণনা শেষে রাতে ফল ঘোষণায় সদরে ৩৩ দশমিক ৮৯ (৭ শতাংশ বেশি), মুক্তাগাছায় ৩২ দশমিক ১৯ (৭ শতাংশের বেশি) ও গৌরীপুরে ৪১ দশমিক ৩৮ (১১ শতাংশের বেশি) শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানায় ইসি সচিবালয়।

একইভাবে তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম থেকে বিকেল ৪টায় ঢাকায় পাঠানো প্রতিবেদনে বোয়ালখালীতে উপস্থিতি ৩৮ দশমিক ১১, পটিয়ায় ২৮ দশমিক ৫০, আনোয়ারায় ৪১ দশমিক ৬৭ ও চন্দনাইশে ৩৬ দশমিক ৩১ শতাংশ উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ঘোষিত ফলাফলে তা বোয়ালখালীতে ৩৮ দশমিক ৩০, আনোয়ারায় ৪২ দশমিক ২৭, পটিয়ায় ৩১ দশমিক ৭৭ ও চন্দনাইশে ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ। শুধু পটিয়া ও চন্দনাইশে তিন থেকে চার শতাংশ কম-বেশি হয়েছে; অন্য উপজেলায় রয়েছে প্রায় একই।

দ্বিতীয় ধাপে ঝালকাঠি সদরে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়ে ৭৪ হাজার ৬১৪টি। এর মধ্যে বাতিল হয় ২ হাজার ২৬ ভোট। এখানে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭৪ হাজার ৬০৮ ভোট পড়লেও বাতিল হয় ৪ হাজার ৮টি। আর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়ে ৭৪ হাজার ৩২৬টি। এর মধ্যে বাতিল হয় ৩ হাজার ৬৯৪ ভোট।

ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের মতে, তিন পদে একই সংখ্যক ভোট পড়ার কথা। কারণ একজন ভোটার কেন্দ্রে এলে তাঁকে তিন পদের জন্য পৃথক তিনটি ব্যালট পেপার দেওয়া হয়। তিনি সিল দিয়ে ব্যালট বক্সে রাখেন, যেটি প্রদত্ত ভোট হিসেবে গণ্য। ওই কর্মকর্তাদের মতে, নানা কারণে বৈধ ও অবৈধ (বাতিল) ব্যালট পেপারের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে।

কিন্তু প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। এর পরও কোনো কারণে ভিন্ন হলে, বেশি ব্যবধান অস্বাভাবিক।

ইসি সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী সমকালকে বলেন, ভোট গণনার আগে ও পরের তারতম্য এক থেকে ২ শতাংশ ঘটতে পারে। এর বেশি হলে তা স্বাভাবিক নয়।

একাধিক আলোচিত নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী সাবেক এ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, একই নির্বাচনে একাধিক পদে ভোটার উপস্থিতি ভিন্ন হওয়ার সুযোগ কম। এমন হতে পারে– কেউ হয়তো চেয়ারম্যান পদে ভোট দেবেন, অন্য দুই পদে দেবেন না। সে ক্ষেত্রে যে ব্যালটে ভোট দেবেন সেটা গণ্য হবে, বাকি দুই পদের ব্যালট বাতিল বলে গণ্য হবে। জেসমিন টুলীর মতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট কেন্দ্রে উপস্থিত থাকেন। একজন ভোটার কেন্দ্রে ঢুকলেই ভোটার তালিকা মিলিয়ে একটি ভোট কাউন্ট হয়ে যাবে। তাকে তিন পদের জন্যই তিনটি ব্যালট দেওয়া হবে।
তাঁর বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় তৃতীয় ধাপে ইভিএমে ভোট নেওয়া উপজেলাগুলোর ফলাফলে। ইসি সচিবালয় থেকে পাওয়া ২৯ মে অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপের ফলাফলে দেখা যায়, ইভিএমে ভোট হওয়া সিরাজগঞ্জ, পাবনা, যশোর, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, জামালপুর ও কক্সাবাজারের উপজেলাগুলোয় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোটার উপস্থিতি একই। এসব উপজেলায় একটি ভোটও এক পদের সঙ্গে আরেক পদের হেরফের হয়নি। কিন্তু ব্যালটে ভোট হওয়া উপজেলাগুলোতে এক পদের সঙ্গে আরেক পদের ভোটার উপস্থিতি মিলছে না।

ময়মনসিংহ ও ঝালকাঠির মতো এমন অসামঞ্জস্য অনেক উপজেলার ফলাফলেই পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে ইসি কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সমকালকে বলেন, একই উপজেলায় তিন পদে তিন ধরনের ভোটার উপস্থিতির সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগ ইসির কাছে আসেনি। ইসি সচিবালয়ের সরবরাহ করা ফলাফলে এমন চিত্র থাকলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।

ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিস্থিতি প্রতিবেদনে ভোটার উপস্থিতির হার উল্লেখ করার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা।
সমকালের হাতে আসা একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত ভোটার উপস্থিতির হার উল্লেখ করা ফলাফলের নথির বিষয় জানালে অশোক কুমার বলেন, পরিস্থিতি প্রতিবেদনে ভোটার উপস্থিতির হার উল্লেখ করা রিটার্নিং কর্মকর্তার ভুল। কারণ কমিশন অ্যাপসের মাধ্যমেই উপস্থিতির হার সম্পর্কে অবহিত হয়। যদিও অ্যাপসে আপডেট দেওয়ার দায়িত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকলেও তারা নানা কারণে যথাযথভাবে দিতে পারছেন না।

চলমান ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতির রেকর্ড হয়েছে। এরই মধ্যে অনুষ্ঠেয় তিন ধাপের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। আগামীকাল বুধবার ৫ জুন শেষ অর্থাৎ চতুর্থ ধাপের ভোট গ্রহণের কথা রয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে স্থগিত ২০ উপজেলার ভোট হবে ৯ জুন।

samakal