টানা ২২ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে বাংলাদেশে। পুরো সময়জুড়ে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও এ মূল্যস্ফীতিকে এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা খাতের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিও এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে দেশের মূল্যস্ফীতির গতিবিধি পর্যালোচনা করে বুধবার ‘ইনফ্লেশন ডায়নামিক্স ইন বাংলাদেশ: জানুয়ারি-মার্চ ২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মূল্যস্ফীতির (হেডলাইন) গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এ মূল্যস্ফীতিতে পণ্য ও সেবা খাতের (কোর) অবদান ছিল ৪৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ৪৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ জুড়ে ছিল খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অবদান ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এর আগে গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে গড় হেডলাইন মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। সে সময় এ মূল্যস্ফীতির ৫৬ দশমিক ১৮ শতাংশ জুড়ে ছিল খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এছাড়া এতে পণ্য ও সেবা খাতের অবদান ছিল ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অবদান ছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
দেশে গত দুই বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। সর্বশেষ গতকালও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। নতুন ঘোষণায় ডিজেল ও কেরোসিনের বেড়েছে লিটারে ৭৫ পয়সা। এ অনুযায়ী ডিজেল ও কেরোসিনের নতুন দাম এখন প্রতি লিটার ১০৭ টাকা ৭৫ পয়সা। আর আড়াই টাকা বাড়িয়ে পেট্রল ও অকটেনের লিটারপ্রতি দাম নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১২৭ ও ১৩১ টাকা। এছাড়া গ্যাসের দামও গ্রাহক পর্যায়ে গত দুই বছরে বাড়ানো হয়েছে দুবার। আর শিল্প খাতে ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম চলতি বছরেই দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে। আবার বিদ্যুতের দাম গত বছর বেড়েছে তিন দফায়। এরপর চলতি বছরের মার্চে তা আরো এক দফায় বাড়ানো হয়।
ঋণ কর্মসূচির আওতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেয়া শর্ত অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে দাম বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনছে সরকার। সংস্থাটির সর্বশেষ রিভিউ মিশনের সময়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের বছরে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে চারবার। এছাড়া জ্বালানি পণ্যের ক্ষেত্রেও সময়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে দাম সমন্বয়ের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ, যা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশে মূল্যস্ফীতির চাপকে আরো জোরালো করে তুলবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। তাদের ভাষ্যমতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির
দাম বাড়লে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূতসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ বেড়ে দামও বাড়ে। বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ—দুইভাবেই মূল্যস্ফীতিকে চাপে ফেলছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে মূল্যস্ফীতির ওপরে প্রথম দফায় প্রভাব ফেলেছিল টাকার অবমূল্যায়ন। বর্তমানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দ্বিতীয় দফায় মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে, সেটির কার্যকারিতা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, সেটিকে মুদ্রানীতি এখনো প্রশমিত করতে পারেনি। এক্ষেত্রে আরো অন্তত ছয় মাস সময় লাগতে পারে। আর আইএমএফের মতে এক বছরও সময় লাগতে পারে।’
দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালজুড়ে গড়ে ৯ শতাংশে ছিল। এর এক-চতুর্থাংশই এসেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যস্ফীতির কারণে। পাশাপাশি রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বিনোদন কার্যক্রম, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত সেবা এখানে ভূমিকা রেখেছে। ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী, যার হার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া রেস্টুরেন্ট, তামাক, গহনা, ভ্রমণসংশ্লিষ্ট পণ্যও এখানে অবদান রেখেছে। গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় ওই মাসে মূল্যস্ফীতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবদান ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অস্থিতিশীলতার প্রভাবে আমদানিনির্ভর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং এর ধারাবাহিকতায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে ২০২২ সালের আগস্টে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে হেডলাইন মূল্যস্ফীতির এক-তৃতীয়াংশই ছিল আমদানিনির্ভর পণ্যের অবদান। অবশ্য আমদানীকৃত খাদ্যপণ্যের দাম কমায় গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতিতে এ খাতের অবদান কিছুটা কমেছে। যদিও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সামনের মাসগুলোয় এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আগামী বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে হেডলাইন মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে পারে বলে দাবি করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদি সাত্তার মনে করছেন, আগামী অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। কিন্তু টাকার যে পরিমাণ অবমূল্যায়ন হয়েছে শুল্কের পরিমাণও সে হারে বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে এনবিআর রাজস্ব নীতিতে শুল্কের পরিমাণে কিছুটা ছাড় দিলে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে।
গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জীবনযাপনও কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতিতে গত তিন দশকে আর কখনই এত দীর্ঘসময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হতে দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতির জন্য স্থানীয় প্রভাবকের চেয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দায়ী করা হয়েছে বেশি। বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। যদিও বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমা শুরু হয় ২০২২ সালেই। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসা শুরু হলেও ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সত্ত্বেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামের ক্ষেত্রে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিও মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের একটি বিষয় হচ্ছে এর ক্যাপাসিটি চার্জের হিসাব হচ্ছে ডলারে। ফলে টাকার অবমূল্যায়নে ক্যাপাসিটি চার্জও বেড়েছে। বাড়তি এ ব্যয় সমন্বয়ের জন্যই দাম বাড়াতে হয়েছে।’
বিদ্যুতের অব্যাহত লোকসানের চাপ সামাল দিতে না পেরে ২০২৩ সালে তিন দফা খুচরা পর্যায়ে মোট ১৫ শতাংশের বেশি দাম বাড়ানো হয়। এছাড়া ২০২২ সালের নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় মোট ২৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এক বছরের মাথায় এ বছরের মার্চে আবারো বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এক্ষেত্রে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছে গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ, যা কার্যকর হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই।
ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের আগস্টে গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এরপর ২৩ দিনের মাথায় সব জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি তেলে স্বয়ংক্রিয় মূল্যবৃদ্ধির পদ্ধতি ঘোষণা করে সরকার। এরপর গত মার্চ ও এপ্রিলে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানো হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা আগামীকাল থেকে কার্যকর হবে।
গ্যাসের দামও গত দুই বছরে কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৫ জুন গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সমন্বয়ের অংশ হিসেবে গত বছরের জানুয়ারিতে বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। এতে আবাসিক বাদে বাকি সব শ্রেণীর গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে দুই দফায় শিল্প খাতে ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।
bonik barta