আজিজ, বেনজীর ও আজিম—এই তিনে যোগসূত্র কী

আজিজ, বেনজীর ও আজিম—এই তিনে যোগসূত্র কী

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা এবং এমপি আনোয়ারুল আজীমের খুন হওয়া—এই তিন ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি?

অবশ্যই যোগসূত্র আছে। তিনটি ঘটনাই খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে। তিনটি ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনো ধরনের অপরাধ যুক্ত। কেউ অপরাধের শিকার, কেউ অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। দ্বিতীয় যোগসূত্রটি হলো তিনটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিন ব্যক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।

জেনারেল আজিজ আহমেদ সেনাবাহিনী ও বিজিবির প্রধান ছিলেন। বেনজীর আহমেদ র‍্যাব ও পুলিশপ্রধান ছিলেন। আর আনোয়ারুল আজীম পরপর তিনবার জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদের ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী তিনি এখনো সংসদ সদস্য আছেন!

আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগে। আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্য তাঁর কৃতকর্মের দায় নেয়নি। বলেছে, এটা ব্যক্তির দায়, সরকারের নয়।

আজিজ আহমেদ নিজের দায় অস্বীকার করতে গিয়ে বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা উদ্দেশ্যমূলক এবং সরকারকে হেয় করার জন্য করা করা হয়েছে। তিনি যে ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলক বলেছেন, সেই ঘটনার জন্য কি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছেন? জানালে সেটা জানার অধিকার জনগণেরও আছে।

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, সেটা দুর্নীতি দমন সংস্থা তদন্ত করেছে এবং তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন, দুদক স্বাধীন। সেখানে যদি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয় কেউ, আমরা তাকে প্রোটেকশন দিতে যাব কেন? তিনি সাবেক আইজিপি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন তাঁদের শাস্তির কাছে সমর্পণ করবে। এ কারণে কোনো প্রকার সরকারের কাউকে প্রোটেকশন দেওয়ার বিষয় নেই।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজীমকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে জনপ্রিয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি জনপ্রিয়তা প্রমাণ করলেন কখন? ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

আর ২০২৪ সালের ভোট হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম স্বতন্ত্র। সে ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা অর্জনের সুযোগ পেলেন কোথায়? অবশ্য বিএনপির নেতা হিসেবে আনোয়ারুল আজীম ১৯৯২ সালে পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়াকে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ধরা হলে তার কৃতিত্ব সেই দলকেই দিতে হয়।

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছেন, সাবেক পুলিশপ্রধানের বিরুদ্ধে দুদকের নেওয়া পদক্ষেপে সরকারের সমর্থন আছে। সাবেক সেনাপ্রধানও ধরা পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জনসমক্ষে চলে এসেছে। তিনি কোনো অন্যায় করলে সেনাবাহিনী দেখবে।

যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবেক সেনাপ্রধানের বিষয়ে সেনাবাহিনীর করার কিছু নেই। তবে একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, সেনাবাহিনী সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিতে পারে।

তিন ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে খুন করার ঘটনাটি। আজিমকে যাঁরা খুন করার পরিকল্পনা করেছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত চারজন ঢাকা ও মুম্বাইয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু হত্যার মূল হোতা হিসেবে যাঁর নাম এসেছে, সেই আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত হত্যারহস্য খুঁজে বের করেছে, দেশে থাকা অপরাধীদের পাকড়াও করে তাদের জবানবন্দি নিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ তদন্তকাজে পরস্পরকে সহায়তা করছে।

এখানে দুটি সমস্যা হলো খুনিরা আনোয়ারুল আজীমের দেহাবশেষও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। জানা যায় তারা খুনের আলামত মুছে ফেলতে মুম্বাই থেকে এক কসাইকে নিয়ে এসেছিল। পরে সেই কসাই এমপির লাশ টুকরা টুকরা করেছে, হাড় থেকে মাংস বের করে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দিয়েছে।

এ অবস্থায় লাশ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার চেয়েও কঠিন হলো হত্যার মূল অভিযুক্তকে দেশে ফিরিয়ে আনা। দুই দেশের মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনেই এসব অভিযুক্তকে ফেরত আনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ রকম কোনো চুক্তি নেই।

আবদুস সামাদ আজাদ যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শফি শামি পররাষ্ট্রসচিব তখন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত আনার বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হলেও গতি পায়নি। এ কারণে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এ কে এম মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠিয়েছে ইমিগ্রেশন আইনের আওতায়।

আখতারুজ্জামান জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তিনি তার মার্কিন পাসপোর্টে ব্যবহার করে কলকাতায় বাসা ভাড়াও করেছিলেন বলে ভারতের পুলিশ বলেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানানো হয়েছে, আনোয়ারুল আজীমের হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। একেক সময় একেক কথা বলছেন। সে ক্ষেত্রে হত্যা রহস্য উন্মোচন করতে হলে আখতারুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনা জরুরি।

প্রশ্ন হলো ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্যের খুনিদের বিচার হবে কি না। বিচার করতে হলে প্রধান অভিযুক্ত আখতারুজ্জমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যান্য অভিযুক্তকে তার মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু তাঁকে আদৌ নিয়ে আসা সম্ভব কি? আমরা জানি যে রাশেদ চৌধুরীর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটি উপায় আছে বলে মনে হয়। আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন ভারতের মাটিতে। ভারতের সঙ্গে তাদের বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। ভারত চাইলে খুনের বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে আখতারুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুন হলেন চোরাচালানের অভিযোগ মাথায় নিয়ে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘মাদক মামলার মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত (অর্থ পাচার) বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির দুই ভাই আমিনুর রহমান ও আবদুস শুক্কুরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বদির বিরুদ্ধেও যদি আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ পাই, তাহলে ছাড় দেওয়া হবে না। টাঙ্গাইলের সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ওরফে রানার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা আছে। এই হলেন আমাদের জনপ্রতিনিধি, যারা দেশ ও জনগণের ভাগ্যনিয়ন্তা।

prothom alo