হত্যা, গুম, নির্যাতনের রাজনীতি আমদানি করা

Daily Nayadiganta


প্রায়ই এমন সন্দেহ করা হয় যে, গুম-অপহরণ, নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলার মতো অমানবিক অপরাধ শুধু কি আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। এ ধরনের ভয়াবহ অপরাধ করা হয় অপরাধ দমনের জন্য নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার জন্য। এর প্রধান উদ্দেশ্য- জনজীবনে ‘সেন্স অব টোটাল ইনসিকিউরিটি’ বা পুরোপুরি নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা। জনগণ নিরাপত্তাহীন একটা আতঙ্কের পরিবেশে বাস করছে এটা ভেবে যে, যে কেউ তাদেরকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, হত্যা করতে বা তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারে। ইউনিফর্মে থাকার প্রয়োজন নেই, সাদা পোশাকেও হত্যা, গুম চলছে। তারাও দাবি করে, তারা সরকারি লোক। সুতরাং সরকারকে ভয় করে চলুন এবং সরকারের করা কোনো কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করবেন না। সাদা পোশাকধারীরা সরকারি লোক কি না তাও গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা উচিত।

আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত আমাদের লোকেরা এত নিষ্ঠুর হতে পারে যে, নির্যাতনের ফলে প্রায়ই মৃতু্যুর মধ্য দিয়ে ঘটনার শেষ হয়।

অন্যরা তাদের মহিমান্বিত করার জন্য যতই বলুন না কেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ আমাদের প্রস্তুতিতে বা আমাদের নেতৃত্বে হয়নি। পাকিস্তানিরা নিজেদের স্বার্থে আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ পরিচালিত হলেও প্রবাসী সরকারকে যুদ্ধ-পরবর্তী চরম অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। বাঁচার জন্য আমাদেরকে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়তে হয়েছে। ভারতের সাথে মিলে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। আমাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি কিভাবে স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপ নেয় এবং কত অসহায়ভাবে হাজার হাজার লোক নির্মম হত্যার শিকার হয় সে ইতিহাসও ব্যাপক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। যে কারণে আমরা স্বাধীনতার মূল্য দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।

দেশ বর্বর পাকিস্তানি সামরিক শাসনমুক্ত হলো। কিন্তু তাদের ৯ মাস সামরিক শাসনের বর্বরতা ক্ষমতাসীনদের উপেক্ষা করতে অসুবিধা হলো না। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, জনগণের রক্তে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, নেতাদের রক্তে দেশ স্বাধীন হলে জনগণকে গণতন্ত্র বঞ্চিত করার কথা বলা হতো না, অথবা স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশে নিষ্ঠুর দুঃশাসনের প্রশ্ন উঠত না।
বেআইনিভাবে আটক রাখা, অপহরণ, বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড দেশে সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির এক ভয়াবহ চিত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি কেবল আইনের শাসনকেই ক্ষুণ্ণ করে না, বিচার বিভাগকে অসহায় দর্শকও করে তোলে। কোনো ধরনের ন্যায়পরায়ণ মানবিক সমাজ গঠনের পথ এটি নয়।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক চিন্তা থেকে রক্ষী বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড প্রথম শুরু হয়েছিল। তখন আমরা এই গোপন হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেছি। আমি নিজেও বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, পাকিস্তানি শত্রু বলতে বাংলাদেশে কেউ নেই। দেশের লোক শান্তিতে থাকতে চায়। গোপন হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। কতিপয় ছাত্রনেতার পরামর্শই বঙ্গবন্ধুর কাছে বেশি গ্রহণীয় হতো। যখন কোনো সরকারি সংস্থার খুশি বা ইচ্ছায় কাউকে জীবনে শেষ করা যায় তখন সরকারের কাছে জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। বিচারব্যবস্থাও ডি-হিউম্যানাইজড বা অমানবিক হয়ে পড়ে। সংবিধানের আওতায় মানবাধিকারের সুরক্ষা মানবজীবনের মর্যাদাকে মানবিকভাবে বিবেচনা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। শাসনতন্ত্রেই বলা হয়েছে, কোর্টে বিচার ভিন্ন কারো মৃত্যু ঘটানো যাবে না।

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের জুরিসপ্রুডেন্স বা আইনশাস্ত্র থেকে একটি বাক্য উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘কনসিডারেশন অব হিউম্যানিটি’- মানবিকতার বিবেচনা হলো ‘স্যাকরেড ট্রাস্ট অব সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতার পবিত্র বিশ্বাস’, যা আইনি মানদণ্ড গঠনে অনুপ্রাণিত করে।

১৯৭২ সালে রক্ষী বাহিনী নাম দিয়ে দলীয় বাহিনী গঠনের মাধ্যমে সরকারের পরিচালনায় গোপন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল। আইনটি ভয়ঙ্কর হলেও এই বলে এটাকে ন্যায়সঙ্গত দাবি করা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশবিরোধী ‘ভায়োলেন্ট এলিমেন্টস’ বা সন্ত্রাসীদের সহিংস তৎপরতা ছিল এবং তাদের অবশ্যই প্রতিহত করা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে এ মর্মে বিভ্রান্ত করা হয়েছে যে, বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। সরকারের সন্ত্রাসী তৎপরতাই ছিল দেশে একমাত্র ভয়াবহ সন্ত্রাসী তৎপরতা।

সর্বশেষ ঘটনায় কোভিড-১৯ প্যানডেমিক মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাদি সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন ফেসবুকে পোস্ট করায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ২০২০ সালের মে মাসে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ফেসবুকে কমেন্ট করায় লেখক মুশতাক আহমেদও একই দিনে কার্টুনিস্টের সাথে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং ছয়বার জামিন প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে মারা যান। জনসাধারণের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে মুশতাকের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে কিশোর জামিনে মুক্তি পান। তিনি দাবি করেছিলেন, নির্যাতনের কারণে তিনি মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হন ও তার ওজন হ্রাস পায়। তিনি বলেন, আটক থাকাকালে তাকে বাঁশের লাঠি ও রড দিয়ে পেটানো হয়। তিনি ডান কান দিয়ে আর শুনতে পান না, বাম হাঁটু এবং গোড়ালির ব্যথার কারণে কিশোরের হাঁটাচলা করতেও অসুবিধা হয়। এরূপ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার জন্য কি এ দেশের মানুষ জীবন দিয়েছে? সব আন্দোলনে নেতারা নিরাপদ থাকেন বলেই হয়তো সহিংস শাসন চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না।

কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) আওতায় অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সার্বজনীন অধিকার প্রয়োগ করার কারণে তাদের ১০ বছর পর্যন্ত নির্জন কারাবাসের শাস্তি পেতে হবে। তবে সেই কালো আইনও অনুসরণ করা হয়নি। বর্বর নির্যাতন ও মৃত্যু ডিজিটাল আইনের আওতায় হয়নি। ওই কর্মকর্তা বা যারাই হোন না কেন, জনগণের ওপর নির্যাতন চালাতে বা মৃত্যু ঘটাতে তাদের কোনো আইন-কানুনের প্রয়োজন নেই। তাদের এটাও জানার প্রয়োজন নেই যে, কিভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।

এমনকি মুশতাক ও কিশোরের বিচার শুরু হওয়ার আগেই কেউ নির্যাতন ও মৃত্যুর জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সঠিকভাবে দোষ দিতে পারে না। সুতরাং আইনশৃঙ্খলাবিহীন বর্বরতার কারণে অমানবিক নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এ জন্য কোনো আইনেরই প্রয়োজন হচ্ছে না। তারা মনে করেন, বিচার হবে রাজনৈতিক নেতাদের, তাদের নয়। এটা কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ থাকায় কাউকে অপরাধমুক্ত করে না। পরিবর্তন এলে দায়-দায়িত্ব নিজেকেই বহন করতে হবে।

আমার মতে, সরকার এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন যে, পুলিশ ও সরকারে থাকা অন্যরাই টর্চার মেশিনারি বা নির্যাতন ব্যবস্থার কর্তৃত্বে আছে তা নয়। তাদের এটাও তদন্ত করে দেখা উচিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে প্রাইভেট কোনো বাহিনী এসব কাজে জড়িত কি না। জনাব কিশোর দাবি করেছেন, তাকে বিভিন্ন ধরনের লোক মারধর করেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সন্ত্রাসী হতে দেয়া কোনো সুস্থ চিন্তার কথা নয়। এ ধরনের ব্যবস্থা কারো জন্য নিরাপদ নয়। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব সবার। অমানবিক হত্যা-গুমের রাজনীতি আমাদের নয়, আমদানি করা। গোলামি করার বিদেশী রাজনীতি এ দেশের স্বাধীনচেতা লোকদের জন্য নয়।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট