বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত নীতি, কিছু প্রশ্ন

রেজাউল করিম রনি :

বাংলাদেশের ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন যা আমি, তুমি ও ডামি নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে- ভোটের আগে আগে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখেছিল। বলা হয়েছিল, ভারত ও আওয়ামী লীগের স্বার্থেই শেখ হাসিনাকে থামানো উচিত।

আওয়ামী আমলের অন্য দুটি নির্বাচন থেকে গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের একটা বড় পার্থক্য হলো- নির্বাচনের আগেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এবং এটা একদলীয় শাসনের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে তা দেশি-বিদেশি মিডিয়াতে ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছিল।

ভারত যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করার নীতি গ্রহণের কথা সবারই জানা। তার পরেও টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয়টা সামনে চলে আসার পর থেকে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা হলো- তবে কি বাংলাদেশ নীতিতে ভারতের থিংকট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা তৈরি হতে শুরু করেছে। বিজেপি সরকার আর ভারত রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থানের ভিন্নতা কি দ্বন্দ্বের রূপ নিতে শুরু করেছে?
এ বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বিপুল। ভারত উল্টে গেলে ক্ষমতার গণেশও উল্টে যাবে- এমন ধারণা বেশ জনপ্রিয় হওয়াতে এই বিষয়ে মানুষের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক।  আমেরিকা গণতান্ত্রিক নীতির পথে চলার ছবক ও চাপ কোনো কিছুই দিতে কম করে নাই। তারপরও ভারতের ডানায় ভর করে আরও একটা ভোটবিহীন নির্বাচনের পুলসিরাত পার হতে পারাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য ভারতনির্ভরতা আর অর্থনীতির জন্য চীননির্ভরতার বিষয়টি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপি অপেক্ষা করেছে ভারতের অবস্থান কোন দিকে থাকে তা দেখার জন্য। এবং সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের পর পরই শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর পরে দলটি সরাসরি বলেছে, ‘ভারতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের জনগণ ভোটের অধিকার হারিয়েছে’: এই প্রসঙ্গ থাক। আগে আমরা দেখে নিতে চাই আসলেই কি ভারতের নীতি-চিন্তকদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ দেখা দিয়েছে?

১.

ভারতীয় পলিসি-ভাবুকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি দরদী এমন কয়েক জনের লেখালেখি ও বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়লে বিরোধটা বের করতে পারা তেমন কঠিন কিছু না। নির্বাচনের পরে শ্রীরাধার বক্তব্যও ছিল অবাক করা। তিনি সব মিলে ১০% ভোট পড়ে থাকতে পারে বলে মনে করেছে। এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে লীগের পক্ষে যায় এমন কোনো কমেন্ট করা তার জন্য মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে ভারতের নীতিগত বিরোধ বা ভিন্নতার চিত্র পরিষ্কার হয় নাই। কিন্তু নির্বাচনের পরে প্রকাশিত ভারতীয় দু’জন বিশ্লেষকের দুইটা লেখা আমরা পাশাপাশি পড়লে ভারতের অবস্থানে একটা বিরোধের চিত্র ফুটে উঠতে দেখি।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ও নরেন্দ্র মোদির সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপ-উপদেষ্টা পঙ্কজ সরণ। ভারতের চিন্ত-সংস্থা বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে গত ১৮ই জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ নির্বাচন এবং তার পরের অবস্থা’ -নামে একটি লেখা লিখেছেন। লম্বা লেখা। পুরোটা ধরে ধরে আলাপ না করে আমাদের জন্য দরকারি পয়েন্টগুলো খেয়াল করলেই আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্য যথেষ্ট হবে।

এই লেখাতে আওয়ামী লীগের নেতারা ঠিক যেই ভাষায় কথা বলেন। যেভাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেন তিনিও তাই দিয়েছেন। জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার স্বার্থে নির্বাচন বর্জন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে এরা গণতান্ত্রিক দাবি মনে করেন না। গণতান্ত্রিক দাবি মনে করেন ভোটহরণের নির্বাচনকে। ফলে বিএনপি ও বিরোধীরাই গণতন্ত্র বুঝে না। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বুঝলে তারা লীগের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে বিরোধী দল হইতো-এমন কথা বলেছেন পঙ্কজ। অন্যদিকে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে বেশ সরস কৌতুক করেছেন। আমেরিকা দুনিয়ার কোথায় কোথায় অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কাজ করে তেমন কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। ইরান ও মিশরের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন মার্কিনিদের সেইসব নির্বাচিত সরকার ভালো লাগে না। ফলে পঙ্কজ আমেরিকার সমালোচনা করে বলেন, অনেক ধরনের গণতন্ত্র আছে। একটা দেশে কেমন গণতন্ত্র হবে তা ঠিক করবে সেই দেশের জনগণ। তিনি মনে করেন, এখন বিতর্ক শেষ, অনিশ্চয়তা গত এক বছরে যা ছিল তা কেটে গেছে। নতুন সরকার শপথ নিয়েছে। এখন কাজে ফেরার সময়-এটাই পঙ্কজ বাবুর মতামত। সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো সম্পর্কে শেখ হাসিনা বেশ ভালো মতোই অবগত। ফলে তিনি সরকারকে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া থেকে বিরত থেকে পশ্চিমাদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও সুন্দর ও মজবুত করতে দুই দেশের সরকারকেই নসিহত করেছেন। তিনি মনে করেন দুইটি দেশেই আগামী পাঁচ বছর সরকারের কোনো পরিবর্তন হবে না। আওয়ামী লীগের ভারতের প্রতি যেমন মনোভাব এবং ভারতের আওয়ামী লীগের প্রতি যেমন অবস্থান তার নিখুঁত প্রতিফলন এই লেখাতে পাওয়া যায়।

২.
আরও একটি লেখা নিয়ে কথা বলি। ভারত সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েটের একজন উপ-পরিচালক ছিলেন ড. বিভুপ্রসাদ রাউট্রে। গত সপ্তাহে তিনি ইউরেশিয়া রিভিউয়ে একটি লেখা লিখেন। যার শিরোনাম: ‘ঢাকায় নয়াদিল্লি কৌশলগত চ্যালেঞ্জে’।
নির্বাচনকে তিনি প্রহসনের রীতি হিসেবে দেখেন। এই সরকারের আমলের নির্বাচনগুলোতে কয়েক মাস আগেই ফলাফল কী হবে তা ঠিক হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন বিভুপ্রসাদ। নরেন্দ্র মোদির অভিনন্দন টুইটে গণতন্ত্র কথাটিই ছিল না। অন্যদিকে ১১ই জানুয়ারি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনও সরকারকে স্বাগত জানায়। তিনি মনে করেন, ভারত দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হওয়ার পরেও এমন স্বৈরতন্ত্রের সমর্থন জানায় শুধুমাত্র নিজের কৌশলগত স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। অন্যদিকে নির্বাচনের পর পর যুক্তরাষ্ট্র জানান, এটাকে তারা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মনে করে না। জাতিসংঘ মানবাধিকার নিয়েও উদ্বেগ জানায়।

এমন একটি দেশে শুধু কৌশলগত ভাবে ভারতের সমর্থন জানানোর নীতিকে তিনি ধোঁয়াশাপূর্ণ ব্যাপার মনে করেন। ভারতের বিএনপি’র সঙ্গে সমস্যা বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। ভারতের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগ কেন প্রথম পছন্দ তাও আলোচনা করেন। কিন্তু তারপরেও মত দেন দিল্লি বাংলাদেশকে আরও চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা থেকে রুখতে সফল নাও হতে পারে। কারণ- এই সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরেও অর্থনীতির অবস্থা ভালো হবে না। বাংলাদেশে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সতর্ক বন্ধুত্ব বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে তাতে ভারতের বাণিজ্য স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। সব মিলে এমন অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থনের মধ্যদিয়ে দিল্লি একটা ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

শেখ হাসিনা আবারো নির্বাচিত হওয়াতে রাজনৈতিক বিরোধ বাড়বে। সহিংসতার সম্ভাবনা বাড়বে। তিনি মনে করেন, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাওয়া শাসককে সমর্থন করার বদলে ঢাকাকে চাপ দিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য করার নীতিই দিল্লিকে নিরাপদ রাখতে বেশি কার্যকর হবে। তা না হলে ভারতবিরোধিতা চরম আকার ধারণ করতে পারে যা দিল্লির নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে।
৩.
আমরা দুইজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের বয়ান শুনলাম। এবং তাদের বক্তব্য তথা অবস্থানের ভিন্নতা আশা করি পাঠকের কাছে পরিষ্কার। এই দুই আলোচকের পরিচয় ও লেখা থেকে আমরা ভারতের আওয়ামী লীগকে একচ্ছত্র সমর্থনের নীতির মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হচ্ছে এই অনুমানের পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণ পাই।

আমরা যদি প্রকৃত অবস্থা বিচার করে দেখি তা হলে দেখবো আসলেই ভারতের এই নীতি দিল্লিকে বিপদে ফেলতে পারে। সরকারের চরম দমন ও ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এখানে এতদিন শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে উঠতে না পারলেও আমেরিকার স্যাংশন ও ভিসা নীতির প্রয়োগের ফলে আন্দোলন করার স্পেস তৈরি হতে শুরু করেছে। এখানে যেকোনো এন্টি আওয়ামী আপ রাইজিং একই সঙ্গে এন্টি ইন্ডিয়ান আপরাইজিং হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এতদিন ভারতের সঙ্গে বিএনপি সরাসরি বিরোধিতায় না গেলেও বিএনপি’র মধ্যে ভারতবিরোধী ও ভারতের প্রতি নমনীয়-দুইটা গ্রুপের মধ্যে বিভেদ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, ভারতবিরোধী অংশই প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। বিএনপি’র একটি অংশ মনে করেন, আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনাকে অন্যায় ভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। অথচ এটা বিএনপি আমলের একটি সফলতা। অস্ত্রগুলো ভারতের মাটিতে পৌঁছার আগেই বিএনপি সরকার আটক করতে সক্ষম হয়। যার জন্য বিএনপি ভারতের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আশা করতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার উল্টো বয়ান বেশি প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ফলে ভারত আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতাকে এতটাই বিস্তৃত করেছে যে, অনেক ভারতীয় মিডিয়া নির্বাচনের ‘র’-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা করে। বাংলাদেশেও বিষয়টা এখন ওপেন সিক্রেট।
অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে যে ধরনের সাড়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তা ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের মতোই আরও একটি নীরব গণপ্রতিরোধের অবস্থা- ভারতের বাণিজ্যের জন্য তৈরি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিম বাংলার বিজেপিবিরোধী প্রবল অবস্থানের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের মোদিবিরোধী মনোভাবে জোয়ার যুক্ত হলে- বাংলায় মোদির আধিপত্য বিস্তারের অনেকদিনের স্বপ্ন আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সমপ্রতি বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে রামমন্দির উদ্বোধনে মোদি যে দৃষ্টিকটু আনুষ্ঠানিকতা দেখালেন তা ভারতের সমপ্রীতিবাদী জনগণ তেমন ভালোভাবে নেয় নাই। বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ও ক্ষোভ দেখা গেছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের ভারত বিরোধিতার পালে বেশ জোরে একটা হাওয়ার ঝাপটা দিয়ে গেল। শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে চারদিকের ভারত বিরোধিতার জোয়ারকে আরও উস্কে দিয়ে ভারত নিজের স্বার্থ কতোটা হাসিল করতে পারবে, নিরাপত্তা কতোটা সুরক্ষিত থাকবে- এটাই এখন ভাবাচ্ছে নীতি-গবেষকদের।

অনেকে মনে করেন- বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত মার্কিন অবস্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ধীরে ধীরে আমেরিকার অবস্থানের কাছাকাছি আসার পথে হাঁটলে চীনকে ঠেকানোতে যেমন মার্কিন সহযোগিতা বাড়বে, নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকিও কমবে। আমেরিকা সুপার পাওয়ার। আর সুপার পাওয়ার কখনো রিজিওনাল পাওয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের নীতিকৌশল গ্রহণ করে না। আমেরিকার অবস্থান নিয়ে পরের কিস্তিতে লেখার ইচ্ছা রইলো।

লেখক: চিন্তক ও সম্পাদক, জবান

মানব জমিন