আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে ব্যাংকের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে আমানত এবং ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল ঢাকায় আইএমএফ মিশনের সফরের শেষ দিনে এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এর নীতি সুদহার, অর্থাৎ ব্যাংকগুলোতে ধার দেওয়ার সুদহার আরও বাড়িয়েছে। একই দিন বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করা হয়েছে। এর ফলে এক দিনে এক লাফে ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করে গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোকে জানিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আইএমএফের পরামর্শে নেওয়া এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
প্রজ্ঞাপন জারির আগে গতকাল সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সেখানে বলা হয়, সুদহার এবং ডলারের দর নিয়মিত তদারক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একবারে যেন সুদহার অনেক না বাড়ে। আবার ডলার বেচাকেনায় যেন ব্যাংকভেদে একেক রকম দর না নেওয়া হয়। স্মার্ট পদ্ধতিতে এখন সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা রয়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর চেয়ে যেন অনেক বাড়ানো বা কমানো না হয়। আর নতুন পদ্ধতিতে ডলারের ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে বেচাকেনায় সর্বোচ্চ এক টাকা কম বা বেশি করার বিষয়ে মৌখিকভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। এর মানে, ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৮ এবং সর্বনিম্ন ১১৬ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য দুপুর আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভাকক্ষে ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এসব সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানানোর জন্য উপস্থিত হন। তবে গত দেড় মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে সব গণমাধ্যমকর্মী সংবাদ সম্মেলন বর্জন করেন।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি যাচাইয়ে একটি টিম ঢাকা সফরে আসে। গতকাল শেষ দিন বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে সুদহার বৃদ্ধি ও ডলারের দর নির্ধারণে ক্রলিং পেগ চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে সংস্থাটি।
আইএমএফ বলেছে, ডলারের দর বাড়লে প্রতিযোগী সক্ষমতা বেড়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণীয় হবে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। আর সুদহার বৃদ্ধির ফলে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এসব সিদ্ধান্তের ফলে স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়তে পারে।
মতামত জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম সমকালকে বলেন, বাজারভিত্তিক করায় সুদহার বাড়তে পারে। এতে বিনিয়োগ হবে কম। আর ডলারের দর বৃদ্ধি রপ্তানিকারক ও রেমিটারদের জন্য ভালো। তবে আমদানিতে খরচ বাড়বে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নজর রাখতে হবে আগের মতো আবার যেন ডলার ১২৪ থেকে ১২৫ টাকায় উঠে না যায়।
ডলারের দর বৃদ্ধির ঘোষণার পর গতকাল বিকেলে খোলাবাজারে ১১৯ টাকায় উঠে যায়। সকালে যা ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে দর ছিল ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এ সিদ্ধান্তের বড় প্রভাব পড়বে সরকারের ব্যয়ে। কেননা, সার, বিদ্যুৎ, খাদ্যসহ বিভিন্ন আমদানির দায় মেটাতে সরকার ১১০ টাকায় ডলার পেত। এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা দরে কিনতে হবে। এর ফলে ব্যয় অনেক বাড়বে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, দেরিতে হলেও সুদহার বাজারভিত্তিক করা ও ডলারের দর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। দুই বছর আগে এমন সিদ্ধান্ত নিলে আজকের এ অবস্থা তৈরি হতো না। এতে হয়তো সাময়িক একটা চাপ তৈরি হবে, তবে মূল্যস্ফীতিতে তেমন প্রভাব পড়বে না। কেননা, এমনিতেই তো ডলারের দর ১১৬ থেকে ১১৭ টাকা ধরে পণ্য আনা হচ্ছে। আবার সুদহার বৃদ্ধির কারণে আগামী মাসেই মূল্যস্ফীতি কমবে না। তবে ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে কিছুটা কমতে পারে।
সুদহার নিয়ে নির্দেশনা
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত ছিল ৯ শতাংশ। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর গত বছরের জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে ‘স্মার্ট’ নামে নতুন পদ্ধতি চালু হয়। স্মার্ট বা সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে হার নির্ধারিত হয়ে আসছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত মার্চের স্মার্ট প্রকাশ করে। সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে বাজারভিত্তিক করার কারণে সুদহার আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকাররা। কেননা সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে এখন সুদ পাওয়া যাচ্ছে ১১ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি। এর ফলে আমানতের সুদহার বেড়ে ঋণের সুদও বাড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে সুদহার সম্পূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক করতে স্মার্টভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হলো। এখন থেকে চাহিদা ও যোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুদহার নির্ধারিত হবে। ব্যাংকগুলো খাতভিত্তিক সুদহার ঘোষণা করবে। তুলনামুলক ঝুঁকি বিবেচনায় গ্রাহকভেদে ঘোষিত হারের চেয়ে ব্যাংক ১ শতাংশ কম বা বেশি সুদ নিতে পারবে। তবে ঋণের মঞ্জুরিপত্রে সুদহার অপরিবর্তনশীল বা পরিবর্তনশীল স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পরিবর্তনশীল হলে বছরে সর্বোচ্চ কতবার বাড়ানো হবে এবং কত শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, আবশ্যিকভাবে তা উল্লেখ করতে হবে।
এতে বলা হয়, কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ হবে চলমান ঋণ বা তলবি ঋণে সম্পূর্ণ ঋণস্থিতির ওপর এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ওপর সর্বোচ্চ দেড় শতাংশ দণ্ড সুদ আরোপ করা যাবে। ঘোষিত সুদহারের অতিরিক্ত কোনো সার্ভিস চার্জ নেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজ, বিশেষ তহবিল পুনঃঅর্থায়ন বা প্রাক-অর্থায়ন তহবিলের আওতায় প্রদত্ত ঋণের সুদহার নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট তহবিলের নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করা ও বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি সাময়িকভাবে হয়তো চাপ তৈরি করবে। তবে শিগগিরই স্থিতিশীল হয়ে আসবে। এ ছাড়া এখন সুদহার যে পর্যায়ে রয়েছে, এখান থেকে খুব বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না।
নীতি সুদহার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ল
মুদ্রানীতি আরও সংকোচন করতে সব ধরনের নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে টানা পাঁচ দফায় বাড়ল ২ দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট। এখন থেকে এক দিন মেয়াদি ধারের সুদহার হবে সাড়ে ৮ শতাংশ। এতদিন যা ৮ শতাংশ ছিল। এ ছাড়া করিডোর স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি বা আন্তঃব্যাংক ধারের সর্বোচ্চ সুদ নেওয়া যাবে ১০ শতাংশ। এতদিন যা সাড়ে ৯ শতাংশ ছিল। এ ছাড়া আন্তঃব্যাংক লেনদেনের নিম্নসীমা তথা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি হবে ৭ শতাংশ। এতদিন যা সাড়ে ৬ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত নভেম্বরে নীতি সুদহার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়েছিল। তখন বলা হয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এটা করা হয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে গত ডিসেম্বরের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। যদিও মূল্যস্ফীতি আগের মতোই ১০ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে। ফলে নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম সমকালকে বলেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করা, ডলারের দর বৃদ্ধি এবং নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সাময়িক চাপ তৈরি হবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বাজার স্থিতিশীল হবে। এ ছাড়া ডলার কেনাবেচার আর অনেক দর থাকবে না। সব ব্যাংক একই দরে ডলার বেচাকেনা করবে।
ডলারের দর এক লাফে বাড়ল ৭ টাকা
ডলারের দর নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে এক লাফে ডলারের দর ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় এতদিন প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে সর্বোচ্চ ১১০ টাকায় বিক্রি করতে বলা হয়। তবে বেশির ভাগ ব্যাংক এ দর মানছিল না। এ রকম অবস্থায় ডলারের মধ্যবর্তী দর ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ১১৭ টাকা। সার্কুলারের বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহক এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী এ দরের আশপাশে অবাধে বেচাকেনা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে, তারা যেন সর্বোচ্চ এক টাকা বেশি বা কম দরে লেনদেন করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দর ৮০ টাকার ঘরে চাপিয়ে রেখেছিল। তবে করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাপ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়। এতে করে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানো রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। রিজার্ভ কমা এবং ডলারের দর দ্রুত বাড়তে থাকায় আমদানিতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা ডলারের দর নির্ধারণ করে আসছে। যদিও নির্ধারিত দরের বেশিতে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। গত কয়েক দিন ব্যাংকভেদে ১১৫ থেকে ১১৭ টাকায় ডলার বেচাকেনা হচ্ছিল। এখন ডলারের দর বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে। অবশ্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও বাড়বে।
samakal