বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ব্যাংক খাতে এখন নাটক চলছে। আত্মীয়তার সূত্র অথবা ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্যে ঋণ মেলে, যা পরে খেলাপিতে পরিণত হয়। ঋণখেলাপিরা জাতীয় নির্বাচন করতে পারবে না– এমন আইন ছিল একসময়। পরে আইন পরিবর্তন করে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। নির্বাচিত হলে আর ঋণ পরিশোধ করতে হয় না খেলাপিদের।
গতকাল রোববার ‘ইজ দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল?’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাত নিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এতে প্রধান অতিথি ছিলেন।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণকে যথাযথ সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সবার জন্য বৈষম্যহীন প্রাতিষ্ঠানিক সেবার বদলে সেবাদানের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় বিবেচনা করা হয়। একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবে এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসব প্রতিষ্ঠানকে এখন আর মানুষ বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন, যে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে সে দেশে কেন বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সুশাসনের অভাব প্রসঙ্গে বিভিন্ন বক্তার সমালোচনা প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে ড. মসিউর রহমান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে সরকার। তবে রাতারাতি সব সংস্কার সম্ভব নয়। তিনি স্বীকার করেন, আগের তুলনায় ঋণখেলাপির সংখ্যা কমলেও পরিমাণে বেড়েছে খেলাপি ঋণ, যা ব্যাংক খাতে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এ কারণে শিল্পায়নে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তরা পর্যাপ্ত ঋণ পান না। এনবিআরকে স্বায়ত্তশাসিত করার আলোচনার জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা মনে করি না। কারণ, স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার পরও রাজনৈতিক প্রভাব থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন হয়নি, এর পরও প্রবৃদ্ধি হয়েছে– এটাই হয়তো প্যারাডক্স। তবে এই উন্নয়ন কতটা স্থায়ী। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার উন্নয়ন সম্ভব না হলে অর্থনীতি এক পর্যায়ে ভেঙে পড়বে। সংস্কার হলে কারা লাভবান হবে আর এখন সংস্কার না হওয়ার কারণে কারা লাভবান হচ্ছে– তা বোঝার বিষয় আছে। প্রভাবশালী রাজনীতিক, দুর্নীতিবাজ আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কারণে সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, এ চক্রটি সংস্কারের পক্ষশক্তির চেয়ে শক্তিশালী। কারা আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী, সম্পদ কোথায় যাচ্ছে– সবারই জানা। এর পরও কোনো পদক্ষেপ নেই।
আলোচনায় যুক্তরাজ্যের উলস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এস আর ওসমানি বলেন, সাধারণত সুশাসন না থাকলে উন্নয়ন হয় না। তবে বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা যেমন আছে, তেমনি ভালো কিছু উদাহরণও আছে। অথচ এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসে না। অবশ্যই একই সাথে কার্যকর এবং অকার্যকর উভয় প্রতিষ্ঠান সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে।
‘ইজ দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল?’ গ্রন্থটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশাসহ কয়েকজন শিক্ষক রচনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন যৌথভাবে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান, ড. ফ্রাঁসোয়া বুরগনিওন এবং ড. ওমর সালাম। গ্রন্থের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ড. সেলিম রায়হান বলেন, বইটির প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, অংশীজনের জরিপ প্রাথমিক শিক্ষা, রপ্তানি বৈচিত্র্য, ব্যাংকিং খাত এবং ভূমি প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে যেসব বিষয় এখন পর্যন্ত অবদান রেখেছে, সেগুলো উন্নয়নের পরের ধাপে যেতে অবদান রাখতে পারবে না। এ ধরনের উন্নয়ন টেকসই নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম, উন্নয়নে সরকারের অর্থসংকট রয়েছে। তাছাড়া একটি শক্তিশালী সংস্কারবিরোধী জোট রয়েছে, যারা দুর্নীতির চক্রকে ভাঙতে বাধা দেয়।
অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, ড. এম হাসান, ড. সায়মা হক, ড. মনজুর হোসেন, ড. কাজী মারুফুল ইসলাম প্রমুখ।
সমকাল