মিনার রশিদ
বর্তমান একদলীয় বাকশাল কায়েমের পর মোজাম্মেল বাবুরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। ঢেকুর তোলার এই কাজটি করছেন নিজের উঠোনে বসে নয়, প্রথম আলোর উঠোনে বসে! মোজা বাবু তার নিজের ৭১ টিভিতে দেশের গণ্যমান্য সুশীলদের ডেকে ঘরের ছেলেদের ঘরে ফিরিয়ে নেয়া হোক-এই আহ্বানটি জানাতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি প্রথম আলোতে কেন কলাম লিখতে গেলেন? এই প্রথম আলোর প্রবেশ তো গণভবনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যার উদ্দেশ্যে এই আহ্বানটি জানানো হয়েছে সেই তিনি তো এই প্রথম আলো ছুঁয়েও দেখেন না। এই পরামর্শটি যেখানে পৌঁছানোর টার্গেট সেখানে মোজাম্মেল বাবু তো সরাসরিই বলতে পারেন।
আসল কথা হলো, প্রথম আলো ছুঁয়ে না দেখলেও এই আলোর আশীর্বাদ তার উপর থেকে এক বিন্দুও কমে যায় নাই। বর্তমান এই বাকশাল তৈরিতে মোজা বাবুর ৭১ টিভির চেয়ে প্রথম আলোর অবদান কোনও অংশেই কম নহে।
আমার এই কথাটি শুনে অনেকেই নাখোশ হতে পারেন। এই বলে যুক্তি দেখাতে পারেন যে প্রথম আলো একটি নিরপেক্ষ পত্রিকা। এখানে সকল মত ও সকল পথের চিন্তাবিদদের চিন্তা – ভাবনা ও মতামত তুলে ধরা হয়। বলতে পারেন, প্রথম আলো যেমন মোজাম্মেল বাবুর লেখা ছাপায় তেমনি বিএনপি পন্থী মারুফ মল্লিকের লেখাও ছাপায়!
আসলে ডাক্তার জাফর উল্লাহ্ ভাইয়ের (উনার সরলতা এবং সবার কাছে ভালো সাজার মানবিক দুর্বলতাকে প্রথম আলো নিজের মতলবে ব্যবহার করেছে) অনুপস্থিতিতে একজন বিএনপি ট্যাগ মারা বুদ্ধিজীবী প্রথম আলোর খুব দরকার হয়ে পড়েছে! সেই কাজটিই সম্ভবত মারুফ মল্লিকদের দিয়ে করানো হবে। বিএনপি দরদী আমাদের আদরের এক ছোট ভাই (যিনি শাহবাগী বলেও গর্ববোধ করেন, পরিতাপ করেন না) বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে মাহমুদুর রহমানকে খোঁচা মেরেছেন। তিনি লিখেছেন, “মাহমুদুর রহমান খুবই ব্রিলিয়ান্ট, অথেনটিক, শার্প। কিন্তু উনার ব্রেনের ৪০% জামাতের দখলে।”
সেই আগুনে কথিত বিএনপি পন্থী কলামিস্ট মারুফ মল্লিক আরেকটু এন্টি-জামাতি ঘি ঢেলেছেন, “(জামাতি পার্সেন্টেজ ৪০ বা ৭০ নয়) আরো বেশি। উনারা মনে করেন বিএনপি কেন এখনো জামায়াতে রূপান্তরিত হচ্ছে না এটা বিএনপির বিশাল অপরাধ।”
কাজেই কোন্ কিছিমের বিএনপি দিয়ে প্রথম আলো মোজাম্মেল বাবুদের মত লীগারদের ব্যালান্স করছেন, তা সহজেই অনুমেয়। আজকে যদি আওয়ামী রাজনীতির প্রয়োজনে জামায়াতের কৌশলগত সহযোগিতা অগত্যা দরকার হয়ে পড়ে তখন মোজাম্মেল বাবুদের জামায়াত এলার্জি মুহূর্তেই উবে যাবে কিন্তু মারুফ মল্লিকদের একই এলার্জি শতগুণে বৃদ্ধি পাবে। এটাই মোজাম্মেল বাবুদের আওয়ামী প্রেম (জামায়াত বিদ্বেষ) আর মারুফ মল্লিকদের বিএনপি প্রেমের (জামায়াত বিদ্বেষ) মধ্যে পার্থক্য। এটি আমার অনুমান নয়। এই সুখকর অভিজ্ঞতা ১৯৯৪- ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ-জামায়াতের মধুচন্দ্রিমার সময় আমাদের হয়েছে।
বিএনপি-আওয়ামীলীগ নিয়ে প্রথম আলোর এই সব ব্যালান্সিং বরাবরই খুবই চিত্তাকর্ষক! গল্পের সেই মতলববাজ বড়ভাই আর বোকা ছোট ভাইয়ের মত। দুই ভাই বাপের সম্পত্তি দুই ভাগ করে যার মধ্যে ছিল একটা গাভী, একটি তালগাছ, একটি কম্বল। এই ভাগ বন্টনে নানা ভাবে বড় ভাইকে সহায়তা করে গ্রামেরই কিছু মহৎপ্রাণ প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সিপিডি, টিআইবি প্রমুখ। গ্রামবাংলার প্রতিটি গ্রামেই এদের অস্তিত্ব রয়েছে।
এদেরই বদৌলতে বড় ভাই প্রথমে গাভীর সামনের ভাগ ছোট ভাইকে দিয়ে নিজে পেছনের ভাগ নেয়। মিষ্টার টিআইবি নিজের কেদারা থেকে উঠে হাতে একটা স্বচছ স্কেল দিয়ে মেপে বুঝিয়ে দেন কোন ভাইয়ের অংশ কতটুকু। এমন নিরপেক্ষ মাপ দেখে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার আর সিপিডি মুহুর্মুহু হাত তালিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলেন।
মিষ্টার সিপিডি রাশিয়া থেকে আহরিত জ্ঞান প্রয়োগ করে দুই ভাইয়ের নিজ নিজ কর্তব্য ও অধিকার বুঝিয়ে দেন।
ছোট ভাই চুক্তিমত গাভীকে সামনের দিকে মুখে খাবার দেয়, বড় ভাই পেছন থেকে দুধ দোহন করে। মজা করে একা একা দুধ খায়। ছোট ভাই কিড়া কাটে (প্রতিজ্ঞা করে), এরপর থেকে আর কোনও কিছুর সম্মুখ ভাগ বা সামনের ভাগ নেবে না। সুযোগ বুঝে এবার বড় ভাই তালগাছের বন্টন আলো- স্টার – সিপিডি-টিআইবি খাজেগানে মজলিশে উত্থাপন করে। আগের বার ধরা খেয়ে ছোটভাই নিজ থেকেই বলে, এবার আমি পেছন মানে গোড়ার দিক নেব। বড় ভাই মহাখুশি। ছোট ভাই, তালগাছের গোড়ায় পানি দেয়, আগাছা পরিস্কার করে আর আগা থেকে বড় ভাই তাল পেড়ে খায়।
পর পর দুই বার ধরা খেয়ে ছোটভাই দ্বিতীয় বারের মত কিড়া কাটে। সামনের বার আর গোড়া/পেছন বা পরের অংশ নেবে না। গ্রামের প্রথম আলো, ডেইলি স্টারও নিজ নিজ নিরপেক্ষ জায়গা থেকে ছোট ভাইকে করণীয় কাজ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রেখেছে। গ্রামে একেকজন ৭১ টিভি, সময় টিভি, ভোরের কাগজ, জনকন্ঠ থাকলেও তাদের কৌশলগত ভূমিকা কম থাকায় এখানে আলোচনায় আসছে না। দিনের বেলায় কম্বল ব্যবহারের মজা, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ও উপকারিতা নিয়ে হাজার হাজার গল্প সারা গ্রামে ছড়িয়ে দেয়া হয়। জাফর ইকবাল নামক এক বিজ্ঞানী গবেষণা করে বের করেছেন রাজাকার নামক ঘৃণ্য প্রজাতির পূর্ব পুরুষরা নাকি রাতের বেলা কম্বল গায়ে দিতেন। এভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার পর কোনও এক শুভক্ষণে খাজেগানে মজলিশে কম্বল বন্টনের ইস্যুটি তোলা হয়। খাজে গানে মজলিশ প্রথমে দিনের ভাগ এবং পরে রাতের ভাগ সম্পর্কে অভিমত জানতে চায়। বড় ভাই আদর করে ছোট ভাইকে তার ভাগ আগে নিতে বলে। ছোট ভাই দিনের বেলাকেই বেছে নেয়।
এর পরের ফলাফল সেই আগের মতই। বড় ভাই মজা করে শীতের রাতে কম্বলের ওম নেয়। আর ছোট ভাই কনকনে শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। এসব দেখে গ্রামের কিছু জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষ এগিয়ে আসেন।
গ্রামে শুধু প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সিপিডি, টিআইবির মত মতলববাজেরাই থাকে না । জ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষেরাও থাকেন। তাদেরই কয়েকজন ছোটো ভাইকে কিছু পরামর্শ দেন। এরপর বড়ভাই যখন গাভীর দুধ দোহাতে বসে তখন ছোটভাই তার ভাগের জায়গা গাভীর মাথায় হাল্কা আঘাত করে। ফলে দুধ দোহানো বড় ভাইয়ের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ছোট ভাইয়ের এই বোধোদয় ও অধিকারবোধ টের পেয়ে বড় ভাই গাভীর দুধ সমান ভাগে ভাগ করতে বাধ্য হয়।
এরপর বড় ভাই তাল পাড়তে গাছে উঠে। ছোটো ভাই একটা কুড়াল নিয়ে গাছের গোড়ায় কুপাতে থাকে। বড় ভাই বলে, আরে আরে করছোস কি? আমি তো পড়ে মরে যাব। ছোট ভাই বলে, আমি তো আমার ভাগে কোপাচ্ছি। তখন বড় ভাই বলে, আর করিস না ভাই। এখন থেকে আমরা তাল দুই ভাগ করে নেব।
এরপর আসে কম্বল। ছোটভাই কম্বলটি দিনশেষে ভিজিয়ে ফেলে। তখন রাতে আর বড় ভাই তা ব্যবহার করতে পারে না। তখন বাধ্য হয়ে বলে, আমার কলিজার টুকরার ছোট ভাই। আগামীকাল থেকে আমরা দুই ভাই কম্বল ভাগাভাগি করে শুইব।
বড় ভাইয়ের হাতে প্রতারিত ছোট ভাইকে সুবিচার পাওয়ার এই কৌশলটিই শিখিয়ে দিচ্ছেন অগ্রজদের মধ্যে শফিক রেহমান এবং মাহমুদুর রহমান। পরবর্তীতে এই সারিতে যোগ দিয়েছেন পিনাকী, কনক সারওয়ার, ইলিয়াস সহ আরো অনেকেই। স্কাইপি কেলেংকারী সহ আরও কিছু বম্বাসটিক রিপোর্ট প্রকাশ করে অলিউল্লাহ নোমানও তার উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। এই নগণ্যেরও একটা ক্ষুদ্র ভূমিকা রয়েছে সেই যায় যায় দিন থেকেই। আমার মত স্বল্প পরিচিত ও নবীন কলামিস্টের নোনতা স্বাদের কলামকে কেন শফিক রেহমানের যায় যায় দিনের মত কাগজে প্রথম ক্যাটাগরির ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে সেটা নিয়ে এদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। এই নগণ্যের যুক্তি ও বক্তব্যের সামনে টিকতে না পেরে এই কুশীলবরা এক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করতেন। কুকুরটাকে একটা খারাপ নাম দাও এবং একে হত্যা কর! এদের তৈরিকৃত সেই কৌশল বা রসগোল্লাটিই হয়েছে জামায়াত। আব্দুন নূর তুষাররা বলতেন, আমার কলাম নাকি জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামের উপযোগী, যায় যায় দিনের নয়।
সেই একই কৌশল এখন, মাহমুদুর রহমান সহ অন্যদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। কাউকে বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার সর্বোত্তম পন্থা হলো তাকে জামায়াত হিসাবে তুলে ধরা। যারাই এখন (উপরে বর্ণিত খাজেগানা মজলিশ কর্তৃক ছোটভাই বানানো) বিএনপিকে চালাক বা টেডনা বানানোর কাজে হাত দিবেন, তারাই এখন জামায়াত বলে চিহ্নিত হবেন। কাউকে জামায়াত ঘোষণার এই মহৎ কর্মটি এখন মোজাম্মেল বাবুদের মুখ থেকে না বলিয়ে মারুফ মল্লিকদের দিয়ে বলানো হবে। এর আলাদা মাজেজা সহজেই অনুমেয়।
শেখ হাসিনা বা বাকশাল এই নব্য বিএনপি প্রেমিক মারুফ মল্লিকদের কাছে বড় ফ্যাক্টর নয়। বড় ফ্যাক্টর এখন মাহমুদুর রহমান।
আসলে এদের বুদ্ধিবৃত্তিক মাতব্বরি মতান্তরে বুদ্ধিবৃত্তিক ইতরামিকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারলে এই জাতির মুক্তি নেই।
মাহমুদুর রহমান কিংবা আমরা কখনোই বিএনপিকে জামায়াত বানাতে চাই না কিংবা জামায়াতকে বিএনপি বানাতে চাই না। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুটি দলের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য চাই। সেই কথা প্রকাশ্যে বলি। দুটি দল নিজ নিজ জায়গাতে থেকেই দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসুক, সেটা চাই। আমাদের এই প্রচেষ্টায় কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে বিএনপি থেকেই হবেন, জামায়াত থেকে নয়।
জামায়াত তথা ইসলাম নিয়ে এদের এলার্জি দেখে রাজনীতির ইসলামি ঢং বনাম মুসলমানী ঢং কলামের মাধ্যমে এই দুটি দলের মধ্যকার পার্থক্য ও মিলের জায়গা গুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলাম। সেখানে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম।
আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কোন্ জামায়াত নেতার পরামর্শে সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যোগ করেছিলেন?
জাতির ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার ঘোষক এই মানুষটি কোন্ জামায়াত নেতার উৎসাহে সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করেছিলেন?
কোন জামায়াত নেতার প্ররোচনায় মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন?
সেই সব প্রশ্নের জবাব ইনারা দেন না। বরং কার মধ্যে কতভাগ জামায়াত রয়েছে সেই গবেষণাটিই এরা করেন। এটিই ওদের জন্যে সহজ কাজ।
এদের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না। ওদের কাজ ওদেরকে করতে দিন। আপনার কাজ আপনি করুন।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক