ধাপে ধাপে প্রভিশন সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ছাড়ের পরও মূলধন ঘাটতি থেকে বের হতে পারছে না কিছু ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর শেষে ১৪ ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। এ তালিকায় সরকারি মালিকানার ৬টি, বেসরকারি ৬টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে দুটি। তিন মাস আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালীসহ ১৫টি ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৩৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক ১১ কোটি টাকার ঘাটতি থেকে সেপ্টেম্বর শেষে ৫৫ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত হয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোর ঘাটতি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনিয়মের কারণে আলোচিত ব্যাংকই ঘুরেফিরে মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এসব ব্যাংক উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণের কারণে প্রয়োজনীয় মুনাফা করতে পারছে না। আবার উদ্যোক্তারাও নতুন করে মূলধন জোগান দিচ্ছে না। অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আলোকে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি পূরণের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা নিয়েছে। অনেক ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বয়ক ও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের আলোকে নতুন করে পরিস্থিতি উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যদিও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুরশেদুল কবীর সমকালকে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। এতে করে বেড়ে যায় মূলধন ঘাটতি। সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হলো খেলাপি ঋণ। অগ্রণী ব্যাংক ২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানোর মাধ্যমে ধাপে ধাপে মূলধন ঘাটতি মেটানোর বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। সে আলোকে খেলাপি ঋণ কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের যেসব ঋণখেলাপি তার বেশির ভাগই অনেক পুরোনো। নতুনভাবে দেওয়া ঋণ যেন খেলাপি না হয়, সে জন্য অনেক যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন করা হচ্ছে।
ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় প্রতিটি ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের খারাপ ঋণ যত বাড়ে, প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তত বেড়ে যায়। আর প্রভিশন রাখতে না পারলে স্বাভাবিকভাবে মূলধন ঘাটতি বাড়ে। আবার খেলাপি হওয়া ঋণের বিপরীতে কোনো ব্যাংক আয় দেখাতে পারে না। ফলে খেলাপি ঋণ না কমলে মূলধন ঘাটতি থেকে বের হতে পারে না।
জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে অধিকাংশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে জনতা ব্যাংকে দুটি শিল্প গ্রুপের ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিলের মাধ্যমে সেপ্টেম্বরে নিয়মিত দেখানো হয়েছে। এতে করে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা কমে ১৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকায় নেমেছে। এর প্রভাবে সামগ্রিক ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ৬৪২ কোটি টাকা কমে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় নেমেছে।
কোন ব্যাংকে কত ঘাটতি
মূলধন ঘাটতি কম দেখাতে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে প্রভিশন রাখার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার সরকারি ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন সময়ে মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। গত সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি ৬ ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এ সময়ে বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। ব্যাংকটির ঘাটতি ১৫ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে থাকা অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ১৫০ কোটি, জনতার ৩ হাজার ৩০ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা এবং রূপালীর ২ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের ৬ ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা। এ খাতের ব্যাংকের মধ্যে ঘাটতিতে শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৪ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৮২৩ কোটি, বাংলাদেশ কমার্সের ১ হাজার ৪০২ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ৬০৮ কোটি, সিটিজেন ব্যাংকের ৯৫ কোটি ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঘাটতি ৮০ কোটি টাকা। অবশ্য সিটিজেন ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে পদ্ধতিগত কারণে। এসব ব্যাংক যখন কার্যক্রম শুরু করেছিল তখন ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজনীতা ছিল ৪০০ কোটি টাকা। এখন তা বাড়িয়ে ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এর বাইরে বিদেশি মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঘাটতি ৪৪ কোটি এবং হাবিব ব্যাংকের ঘাটতি ৩৩ কোটি টাকা।
আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে যা বেশি, সেই পরিমাণ মূলধন রাখতে হবে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মূলধন ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। সামগ্রিক ব্যাংক খাত বিবেচনায় নিলে মূলধন সংরক্ষণের হার মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের যা ১১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এর মানে বেশ কিছু ব্যাংকে মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে।
সমকাল