বিশ্ব অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে পড়েছে পশ্চিমা বাজারগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অনিশ্চিত করে রেখেছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে পোশাক রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তিতে চ্যালেঞ্জ দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদের হারের মতো বিষয়গুলোর কারণে চাপের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এছাড়া ভূ-অর্থনীতির ভবিষ্যৎ ল্যান্ডস্কেপ, উৎপাদনশীলতার দুর্বলতা এবং জটিল আর্থিক পরিবেশে চলতি অর্থবছরের আগামী মাসগুলোয় পোশাক খাতের রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তি কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরো বলছে, সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, তুলার দামের ওঠানামা, কভিড-১৯ মহামারীসহ একাধিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে পোশাক শিল্প। পাশাপাশি ইইউ-ভিয়েতনাম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) পোশাক খাতের সামগ্রিক বাণিজ্য গতিশীলতা পরিবর্তন করেছে। এছাড়া আসন্ন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন দেশের পোশাক শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় বাণিজ্য সংস্কার, বিনিয়োগ নীতিতে সমন্বয়, মেধাস্বত্ব অধিকার সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার ও রফতানি ভর্তুকি প্রত্যাহারের দরকার হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রতিবেদন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকট চলমান রয়েছে। পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে বৈশ্বিক রাজনীতিতেও। রফতানি আয়ের বড় উৎসগুলোর অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। সব জায়গায় সংকোচন নীতি চলছে। রফতানি আয়ের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র এখন সম্প্রসারণমূলক নীতির দিকে ধাবিত হয়নি, দেশটি সংকোচনমূলক নীতিতেই চলছে। সম্প্রতি দেশে শ্রম অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, যা ক্রেতাদের ক্রয় চর্চায় প্রভাব ফেলতে পারে। এরই মধ্যে ক্রেতাদের অর্থ পরিশোধ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে দেখা গেছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) মো. জুলহাস উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পোশাক খাত এখনো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। সেটা ধরে রাখা নিয়ে কিছুটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর যেখানে চ্যালেঞ্জ সেখানে সম্ভাবনাও আছে। দেশের পোশাক খাত অতীতে যেখানে চ্যালেঞ্জ দেখেছে সেগুলো শক্তভাবে মোকাবেলা করে সফলভাবে এগিয়ে গেছে। সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়েই বর্তমান অবস্থায় এসেছে এ খাত। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমরা মনে করি না।’
যদিও পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, এ শিল্পের অনেক উদ্যোক্তারই ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্রয়াদেশ যতটুকু আছে গ্যাস সংকটে সেটাও সময়মতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আবার ব্যাংকিং জটিলতাও অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিকের মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা রকম সংকটের কারণে আগামী দিনগুলোয় রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির প্রবাহ কমে যাবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকায় বিক্রি কম, যে কারণে ক্রয়াদেশ তুলনামূলকভাবে কম। পোশাক কারখানাগুলো যদি অন্তত ৮০ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারে তাহলে লোকসানে থাকে। এ মুহূর্তে ৫০-৬০ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানাগুলো চলছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নানা রকম জটিলতা ও সংকট চলছে রফতানিকারকদের। ব্যাংকে ঋণপত্র হচ্ছে না, ব্যাংক ব্যাক টু ব্যাকের দায় পরিশোধ করছে না। আবার দায় অপরিশোধিত থাকায় নতুন ব্যাক টু ব্যাকও হচ্ছে না। ডলার রেটের কারণে বড় ধরনের শর্টফল হচ্ছে। সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। সব মিলিয়ে অনেকেরই ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্রয়াদেশ যতটুকু আছে সেটাও সময়মতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না গ্যাস সংকটের কারণে। বিভিন্ন সংকটের কারণে আগামী দিনগুলোয় রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির প্রবাহ কমে যাবে। এ রকম একটা সময়ে মজুরি বৃদ্ধি সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে।’
পোশাক রফতানিকারকরা সংকটের কথা বললেও আশার কথা শোনাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রক এ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও সব অনিশ্চয়তা এবং চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসৃষ্ট সংকট পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে দেশের পোশাক শিল্প, আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো থেকে ন্যায্য ক্রয়াদেশ গ্রহণ করছে কারখানাগুলো; তার পরও রফতানি আয় বৃদ্ধিতে পোশাক পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, লিড টাইম হ্রাস এবং দক্ষতা বৃদ্ধি, কার্যকর গবেষণা ও উন্নয়ন নিশ্চিত, নতুন বাজার অন্বেষণ, দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার ক্ষেত্র হওয়া উচিত বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের প্রক্ষেপণ করলেও রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তিতে বড় ধরনের তারতম্য আগে থেকেই ছিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলারের। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ড্যাশবোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, রফতানিকারকরা গত অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানির ঘোষণা (ইএক্সপি) দিয়েছেন ৪ হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের। এ অনুযায়ী পণ্য রফতানি এবং এর বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তিতে গরমিল ৯২৪ কোটি (৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন) ডলারের।