বিদ্যুতের মূল্য বাবদ সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মালিকদের পাওনা দাঁড়িয়েছে দুই বিলিয়ন ডলারেরও কিছু বেশি। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। মূলত চলমান ডলার সংকট, লোকসান বৃদ্ধি ও ভর্তুকির অর্থ যথাসময়ে না পাওয়ায় এ অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ আমদানিনির্ভর হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতনের কারণেও সংকটে পড়েছে খাতটি।
এ সংকট থেকে উত্তরণে করণীয় নির্ধারণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চায় বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে দেওয়া চিঠিতে বিআইপিপিএ বলেছে, চলমান পরিস্থিতিতে এ খাতের উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হওয়ার পথে। টিকে থাকতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
জানতে চাইলে বিআইপিপিএর সভাপতি ফয়সাল খান সমকালকে বলেন, কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিল পেয়েছে। আবার এখন কিছু প্রতিষ্ঠান মার্চের বিল পাচ্ছে। অথচ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিল জমা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে সাত মাসেরও বকেয়া রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসেই বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, পিডিবি পাওনা পরিশোধের সময় ডলারের বিনিময় হার ধরছে ১১১ টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানির জন্য এলসি খুলতে গেলে ব্যাংকগুলো ডলারের দর চাইছে ১২৫ টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলারের দামে পার্থক্য বিদ্যমান থাকলে বেসরকারি বিদ্যুৎ শিল্প টিকে থাকবে না। তাই এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। গত ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বিআইপিপিএ বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিল পরিশোধ করতে বিপিডিবি অত্যন্ত দেরি করছে। এতে এ খাত বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা ও স্থিতিশীলতা হারাচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
এতে আরও বলা হয়, দেরিতে বিল পরিশোধ ও মূলধনি ঋণের উচ্চ সুদহার হওয়ায় মারাত্মক ক্ষতিতে পড়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতনজনিত ক্ষতিতে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
বিল পরিশোধে দেরি হওয়া প্রসঙ্গে বিপিডিবির একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু চলমান ডলারের সংকটের কারণে মূলত তাদের পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তাই বাড়তি ব্যয়ে উৎপাদন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি দামে কিনে তুলনামূলক কম দামে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাত্রারিক্ত লোকসান গুনছে বিপিডিবি। এর বিপরীতে ভর্তুকি বাবদ অর্থ যথাসময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিপিডিবি বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে।
বিপিডিবির লোকসান ও ভর্তুকি
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে লোকসান গুনেছে ৫২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে (সাময়িক হিসাবে) ৫১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই আট বছরের প্রায় কাছাকাছি লোকসান দাঁড়িয়েছে বিপিডিবির। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসান বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার গুণ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছর বিপিডিবির প্রাথমিক প্রাক্কলনে লোকসান ধরা হয় ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি বরাদ্দ রাখে ২৩ হাজার কোটি টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত লোকসান অনেকখানি বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। এতে ভর্তুকি চাহিদাও অনেক বেড়ে যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, গত কয়েক অর্থবছর বাজেটে বিদ্যুতের জন্য যে পরিমাণ ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়, তা দিয়ে দায় মেটানো সম্ভব হয় না। এসব বিবেচনায় নিয়ে আগের অর্থবছরের দায় মেটানোর উদ্দেশ্যে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, সরকারি কোষাগারে অর্থের সংকট থাকায় বরাদ্দ থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা গেছে, যা দিয়ে গত বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনও প্রায় এক বছরের ভর্তুকি বকেয়া রয়ে গেছে। এদিকে গত জুন পর্যন্ত বিপিডিবি থেকে ভর্তুকির যে চাহিদা পাওয়া গেছে, তাতে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ দিয়ে বকেয়ার পাশাপাশি এ অর্থবছরের সর্বোচ্চ দুই মাসের চাহিদা মিটবে। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ না বাড়ানো হলে এ অর্থবছরের অন্তত ১০ মাসের দায় চাপবে আগামী বাজেটে।
সূত্র : সমকাল