আলতাফ পারভেজ :
সংবাদকর্মী বা সমাজ-গবেষক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অনেকে এখন মণিপুর যেতে আগ্রহী। সেখানকার পরিবেশ এ রকম আগ্রহ মেটানোর জন্য যে সহায়ক অবস্থায় নেই, সে-ও অনেকের জানা। তারপরও কেউ না কেউ যাচ্ছেন। এ রকম অনেকে সেখানে গিয়ে প্রথমে খুঁজে নিচ্ছেন মুসলমান কোনো গাইড বা গাড়িচালককে। চাহিদা হিসেবে এটা অভিনব।
দিল্লির এক পরিচিত সাংবাদিক রহস্য করে এ-ও বললেন, মুসলমানদের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ জায়গা এখন মণিপুরের ইম্ফল। কথাটা যে প্রতীকী অর্থে বলা, সেটা বোঝা যায়।
এটা সত্য, মণিপুরে পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত কুকি ও মেইতেইরা মুসলমানদের ‘খুঁজছে’ না বা ‘সুবিধাজনক’ অবস্থায় পেলেও কিছু বলছে না। কিন্তু কঠিন এক হিসাব-নিকাশের খেলায় পড়েছে ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠীও।
হঠাৎ সামাজিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়
অভিজ্ঞরা মণিপুরে মেইতেই ও কুকিদের সহজে চিনতে পারবেন। আবার মেইতেই ও কুকিদের পাশাপাশি একজন মুসলমান নারী বা পুরুষকে শনাক্ত করাও মণিপুরে কঠিন নয়। পরিস্থিতি এখন এ রকম যে, ইম্ফলের ভেতর কুকিদের ঘোরাফেরা কঠিন।
একইভাবে ঝুঁকি আছে ইম্ফলের বাইরে পাহাড়ি এলাকায় মেইতেইদের বিচরণ। কিন্তু দুই জায়গাতেই একজন মুসলমান যেতে পারছেন।
মুসলমানরা আপাতত সেখানে প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর কারও ‘প্রতিপক্ষ’ নয়। কিন্তু তারপরও অতি সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠীও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে আছে; যদিও মণিপুরের মুসলমানদের নিয়ে ভাবছে কমজনই।
উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে আসামের পরই মণিপুরে লোকসংখ্যায় মুসলমানদের হিস্যা উল্লেখযোগ্য। ৯ থেকে ১০ ভাগ। সংখ্যার হিসাবে অবশ্য সেটা সামান্যই। রাজ্যের ৩২ লাখ মানুষের মধ্যে ৩ লাখেরও কম তারা।
এ রাজ্যে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস অনেক পুরোনো—অন্তত ৪০০ বছর তো হবে। একটা কাহিনি আছে এ রকম, পুরোনো দিনের আসামের সিলেট থেকে কয়েক শতাব্দী আগে সেখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে অভিবাসী হয় এই জনগোষ্ঠী। তবে ছোট একটা ভিন্নমত হলো, সিলেট থেকে যাওয়ার আগেই মণিপুরে মেইতেইদের একাংশের মধ্যে ইসলামের গোড়াপত্তন ঘটে গিয়েছিল।
১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সাল, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় ‘দুর্যোগে ভরা সাত বছর’, মিয়ানমারের রাজাদের আগ্রাসনের মুখে মণিপুরিরা আশপাশের অঞ্চলে যে ছিটকে পড়েছিল, তাতে ওই মুসলমানরাও ছিল। এই মানুষদের স্থানীয় আরেক পরিচয় ‘মেইতেই পাঙাল’।
সংখ্যায় কম হলেও যেহেতু রাজ্যে পাঙালরা পুরোনো সম্প্রদায়, এ কারণে কুকি ও মেইতেই উভয়ে এদের ধ্যান-ধরন সম্পর্কে ভালো জানে। আর ওই জানাশোনা এখন তিন পক্ষেরই কাজে লাগছে। তবে কোনো জনপদে সর্বগ্রাসী অশান্তি এলে সবার গায়ে কমবেশি তার আঁচ লাগে।
মণিপুরের চলমান সহিংসতার ভেতর পাঙালদের জন্যও চরম অনিশ্চয়তার উপাদান আছে। তারা কেউ কেউ উদ্বাস্তুও হয়েছে ইতিমধ্যে। হিন্দু মেইতেইপাড়ায় থাকার কারণে তারাও আক্রান্ত হয়েছে।
এসব দেখে তাদের অনেকের মনে পড়ছে, উঁকি দিচ্ছে ১৯৯৩ সালের সহিংসতার স্মৃতি। তবে এবার এখনো মোটাদাগে পাঙালরা আক্রান্ত নয়। বরং ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠী রাজ্যটির বৃহৎদের মধ্যে যোগাযোগ সেতু হিসেবে আছে।
গাড়িচালকসহ অনেক পেশায় মণিপুরি মুসলমানদের চাহিদা বেড়ে গেছে অভাবনীয়ভাবে। হিন্দু মেইতেই আর খ্রিষ্টান কুকিদের এলাকায় উভয় সম্প্রদায়ের কারও যখন কোনো দরকার পড়ে, তখন পাঠানো হয় মুসলমানদের।
কোনো কোনো সময় এ রকম কাজে নাগাদেরও ডাকা হয়, তবে মুসলমানদের চাহিদা বেশি। কারণ, নাগাদের বিরুদ্ধেও মেইতেই ও কুকিদের কিছু কিছু ক্ষোভের নজির পাওয়া যায়। মণিপুরি মুসলমানদের বেলায় সে রকম দেখা যাচ্ছে না এবার।
তবে ইতিহাসে মণিপুরের মুসলমানরা সব সময় নিরাপদে ছিল না; বরং রাজ্যটির ইতিহাসের জঘন্যতম সহিংসতায় ১৯৯৩ সালে তাদের প্রায় ১০০ জন মারা গিয়েছিল।
যদিও তখনকার প্রচারমাধ্যম একে ‘মণিপুরে হিন্দু বনাম মুসলমান দাঙ্গা’ হিসেবে দেখায়, কিন্তু কার্যত ওই ঘটনায় মেইতেই হিন্দু মারা যায় চারজন, অন্যরা সবাই ছিল পাঙাল মুসলমান। পাঙালরা প্রতিবছর ওই সহিংসতায় নিহত মানুষদের ‘শহীদ দিবস’ পালনের মাধ্যমে স্মরণ করে।