- হাফসা সারোয়ার
- ০৯ মার্চ ২০২২, ১৯:৫৬
নব্বই দশকে ব্রেজনেভ শাসনের অবসান ঘটিয়ে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্র হচ্ছে বর্তমান ইউক্রেন। তেল, গ্যাস, খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ শান্তিপ্রিয় জনগণের বাস দেশটিতে। ইউক্রেনের অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ রাশিয়ান বংশোদ্ভূত। দু’দেশের জনগণ কখনোই ভাবেনি, তাদের মধ্যে এমন বৈরিতা হবে। শক্তিধর রাশিয়া তাদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির রাশিয়া বলয় থেকে বেরিয়ে ন্যাট্রোর দলভুক্ত হওয়ার আকক্সক্ষা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে অর্ন্তভুক্তির খায়েশ এবং তাদের সাথে সখ্যতা এবং পশ্চিমা ঘেঁষা নীতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বরদাশত করলেন না।
ক্রেমলিন থেকে বার্তা দেয়া হলো ইউক্রেনের এ নীতি গোটা অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত করবে। রাশিয়া তা কখনই মেনে নেবে না। কেননা ন্যাটো হচ্ছে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক শক্তির অধিকারী। আমেরিকা, ব্রিটেন থেকে শুরু করে ইউরোপের প্রায় ৩২টি দেশ ন্যাটোর দলভুক্ত। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে একযোগে সবদেশগুলোর সামরিক সহায়তা পাবে। ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া রাশিয়ার হস্তগস্ত হয়। পরে বেলারুশও রাশিয়ার আয়ত্বে চলে আসে। ক্রিমিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা তার পাশ দিয়েই কৃষ্ণসাগরের অবস্থান। আমেরিকা কৃষ্ণসাগরে নৌবহর পাঠালে গোটা অঞ্চলই অরক্ষিত হয়ে পড়বে। রাশিয়া তাই গোটা অঞ্চলকে নিজ আয়ত্তে নিতে চায়।
পুতিন অনেক হিসাব কষেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন একজন জনপ্রিয় শাসক হলেও বেশির ভাগ রাশিয়ান জনগণ এ যুদ্ধ চায়নি। কথায় আছে- রাশিয়া যুদ্ধের চিন্তা করে পাঁচ বছর যুদ্ধ করে পাঁচ দিন আর আমেরিকা যুদ্ধের চিন্তা করে পাঁচ দিন যুদ্ধ করে পাঁচ বছর। যুদ্ধে আমেরিকা, ব্রিটেন, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইন্ধন জোগালেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার তৃতীয় দিনেই তারা সাফ সাফ জানিয়ে দেয় যুদ্ধে তারা জড়াতে চায় না। এবং অন্তর্নিহিত কারণও রয়েছে- সুদীর্ঘ সময় মহামারী করোনার অবস্থান, অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সবেমাত্র নিজেদেরকে গোছাতে শুরু করেছে। ইরাক, সিরিয়া যুদ্ধে যত উদ্বাস্তু শরণার্থী ইউরোপীয় দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে, জনগণ ভাবছে এ বোঝা আমরা কেন বহন করব। আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয় তাই বাইডেন প্রশাসনও চাচ্ছে যুদ্ধটা এখন রাশিয়ার দিকেই ধাবিত হোক। এ যেন দুই পরাশক্তির খেলা।
অপর শক্তিধর চীন রাশিয়ার সমর্থক হলেও নীরব পর্যবেক্ষণ করছে। রাশিয়ার বলয়ে থাকা ভারত নীরব রয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট খোমেনি বলেছেন ন্যাটোর উসকানিতেই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হলো। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্য যখন ছিল ইউক্রেন, তখন বেশ ক’টি পারমাণবিক বোমা ইউক্রেনের মালিকানায় চলে যায়। রাশিয়া এ বোমাগুলো দাবি করলে ইউক্রেন তার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি চায়। ১৯৯৪ সালে আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক ইউক্রেন তার হাতে থাকা পারমাণবিক বোমাগুলো রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। রাশিয়া সে চুক্তিও উপেক্ষা করল স্বার্থান্বেষী হয়ে।
রাশিয়ান সৈন্যবাহিনী একযোগে জল, স্থল এবং আকাশপথে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। যুদ্ধের শুরুতেই তাদের হস্তগত হয়ে যায় চারটি শহর। ইউক্রেনের গোটা অঞ্চলেই নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা, সামরিক বিপর্যয়, হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ। রাজধানী কিয়েভে চলছে তুমুল লড়াই। দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর খারকিভের কেন্দ্রস্থলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রয়েছে। কিয়েভ অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে চল্লিশ মাইল দীর্ঘ রুশ সামরিক বহর। রুশ বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে কিয়েভের দখল নিতে। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার দেয়া ভাষণে স্পষ্ট বলেন, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি দেশ ছাড়বেন না। ইউক্রেনীয় জনগণ দেশপ্রেমিক। জনগণের এক বিরাট অংশ স্বাধীনতা রক্ষার্থে তাদের জীবন দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি পশ্চিমা সমর্থক হওয়ায় আফগান প্যালেস্টাইন যুদ্ধে নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। ইউক্রেনে সংখ্যালঘু বহু মুসলিম নিগৃহীত হয়েছে, অনেককে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। ইতিহাস এভাবেই কথা বলে। আজ সেখানে মানবতা কাঁদছে, রক্ত ঝরছে। আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধ অংশ না নিলেও ইতোমধ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী পোল্যান্ড, রোমানিয়াসহ কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ায় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। ইউরোপে রাশিয়ান ব্যাংকগুলো ফ্রিজ করা হয়েছে। তেলের বাজার টালমাটাল। তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গোটা বিশ্বে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হুঙ্কার দিয়েছেন- ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা না হলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রেসিডেন্ট পুতিন অবস্থানে অনড়। তিনি যুদ্ধের মাধ্যমেই ইউক্রেনকে আয়ত্তে এনে তার অধীনস্থ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। জানান দিতে চান তার শক্তি, সামর্থ্য এবং ক্ষমতা। গোটা অঞ্চলের একচ্ছত্র মুরুব্বি হিসেবে সবাই যেন তাকে মান্য করেন।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেন দখলের অভিলাষ সম্ভবত দীর্ঘ এক যুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের সার্বিক চাপ, সামরিক সহযোগিতা প্রতিহত করা গেলেও অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়ার জন্য চিন্তার কারণ বটে। যুদ্ধের পরিণতি সময়ের ব্যাপারে, তবে এটা স্পষ্ট যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবী দুই পরাশক্তিকে ছাপিয়ে ত্রিমাত্রিক ক্ষমতার দিকে ধাবিত হবে।