মরিয়ম চম্পা
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার
বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তা-কাস্টমস কমিশনার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক সদস্যের নেতৃত্বে চলে স্বর্ণ চোরাচালান। গুদামে থাকা জব্দকৃত স্বর্ণ আত্মসাতের মাধ্যমে এদের কেউ কেউ হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। সম্প্রতি ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ লোপাটের সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের এক সদস্য, এক কাস্টমস কমিশনারসহ উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছে তদন্ত সূত্র। ঢাকা কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, স্বর্ণ চুরির ঘটনায় কাস্টমসের নি¤œপদস্থদের পাশাপাশি উচ্চপদস্থদেরও সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। এসব তথ্য ক্রসচেক করে দেখা হচ্ছে। স্বর্ণ চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত ৭ জন কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে। তাদের মধ্যে এনবিআর সদস্য, ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক ও বর্তমান এক কমিশনার ছাড়াও কাস্টম হাউসের এক যুগ্ম কমিশনার, এক উপ-কমিশনার, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম এবং সিপাহি নিয়ামত হাওলাদারের নাম এসেছে। এ ব্যাপারে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছে তদন্ত কমিটি।
মানবজমিনের হাতে আসা এক নথি থেকে জানা যায়, স্বর্ণ চোরাচালানের নেপথ্যে ঘুরেফিরে এক কাস্টমস কমিশনারের নাম সামনে আসছে। নথিতে বলা হয়, কাস্টমসে কর্মরত ওই কমিশনার দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, তার স্ত্রীর নামে শতকোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর মাধ্যমে মানি লন্ডারিংসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০ ব্যাচের এ কর্মকর্তা কাস্টমস ক্যাডারে স্থানান্তর হন শুধুমাত্র অর্থবিত্তের জন্য। তিনি শুল্ক গোয়েন্দা-ঢাকা, বন্ড কমিশনার-ঢাকা, ভ্যাট কমিশনার- ঢাকা দক্ষিণ, ভ্যাট কমিশনার- রংপুর, ঢাকা বিমানবন্দর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্কনীতি শাখাসহ বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেন। সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালানের বিরুদ্ধে বিজিবি, এপিবিএনসহ অন্যান্য সংস্থা তৎপর থাকলেও কাস্টমসের ওই কর্মকর্তা যোগদানের পর থেকে বিমানবন্দরে আগের মতো জব্দকৃত স্বর্ণ আটক দেখানো হয় না। তিনি নিজের পছন্দমত অফিসারকে পদায়ন করে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও স্বর্ণবার চোরাচালান করে আসছিলেন। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়। এ ছাড়া বিমানবন্দরে দায়িত্বরত বিভিন্ন নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবৈধভাবে জব্দকৃত স্বর্ণের মাসোহারা দিতেন। ঢাকা বিমানবন্দরে এই কাস্টমস কর্মকর্তা স্বর্ণ চোরাকারবারিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিত বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়। বিমানবন্দরের কাস্টমস গোডাউনে নিজের পছন্দমত কর্মকর্তা ও সিপাহি পদায়ন করেন তিনি।
যাদের মাধ্যমে গোডাউনে রক্ষিত স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণবার সহজেই বাইরে পাচার করেন। কাস্টমস গোডাউনে সাধারণত কোনো কর্মকর্তাকে ৬ মাসের বেশি দায়িত্বে রাখা হয় না। কিন্তু এই কর্মকর্তা তার পছন্দকৃত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এক বছরেরও বেশি সময় কাস্টমস গোডাউনের দায়িত্বে রাখেন। গত ৩রা সেপ্টেম্বর কাস্টমসের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হওয়ার ঘটনাটি কাস্টমসের এই কর্মকর্তার নেতৃত্বে হয়েছে বলে জানা গেছে। সময় নিয়ে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ভল্ট থেকে সরানো হয়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাস্টমস কর্তৃক বিমানবন্দরে জব্দকৃত স্বর্ণ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়ার কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি।
এই কর্মকর্তার সময়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের বিল অব এন্ট্রি পর্যালোচনায় দেখা যায় জার্মান, হংকং, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডনের মতো উন্নত দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য চালান ইন্ডিয়ান বলে কমমূল্যে শুল্কায়ন করা হয়। এই কর্মকর্তা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ বৈধ করার জন্য স্ত্রীর নামে এমএস ক্যানডিড করপোরেশন বিন নম্বর- ১৯০৮১০১৫৮৩৭ পল্টনে একটি কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। একজন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কতোটা বৈধ সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। কৌশলে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিয়েছেন ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ থেকে। কিন্তু অফিস ও গোডাউন রাখা হয়েছে উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে। এলসি ছাড়া অবৈধভাবে আনা কেমিক্যাল কমমূল্যে স্থানীয় বাজারে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান এমএস ক্যানডিড করপোরেশনের মালিক রেজওয়ানা বনানীকে ফোন দিলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, কাস্টমসের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরির ঘটনার পর কাস্টমস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।