ব্যাংক ও অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জগুলো থেকে নগদ ডলার সংগ্রহ করা দিনকে দিন আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে খোলা মুদ্রাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও নজিরবিহীনভাবে বেড়ে ১২০ টাকায় বিকোচ্ছে এক ডলার, এই দাম দেওয়া অনেকেরই অসাধ্য।
নগদ ডলারের দাম কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টার ফলে মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় ডলারের আনুষ্ঠানিক লেনদেনও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই বর্তমানে সেসব ক্রেতাদের কাছে ডলার বিক্রি করছে– যারা তাদের নির্ধারিত দর দিতে রাজি আছে।
ফলস্বরূপ; ডলার চাহিদার এই চাপ এসে পড়ছে কার্ডের বাজারে। গত ১২ মাসে কার্ডে ক্রমবর্ধমান লেনদেন সংখ্যা, লেনদেনের মোট অঙ্ক এবং নতুন কার্ড ইস্যু ব্যাপকভাবে বাড়ার যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে তার মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হচ্ছে।
জুলাইয়ে কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ এক নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছায়, এসময় ৯.৬৫ লাখের বেশি কার্ডে লেনদেন হয়। একইসঙ্গে, মোট লেনদেনের পরিমাণ এক মাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৭৬৯ কোটি টাকায় পৌঁছায়। জুনে লেনদেন সংখ্যা ছিল ৭.৬১ লাখ , মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫৪৩ কোটি টাকা। পরের মাসে যা বড় পরিসরে বেড়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
একটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যে, গড়ে ৭০ শতাংশ ডলারে লেনদেন ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে হয়। বাকিটা ডেবিট কার্ডে হয় বলে জানান আরেকটি ব্যাংকের কার্ড বিভাগের প্রধান।
তিনি বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার বেশকিছু শর্ত আছে। তাই ডলারে লেনদেন করতে চাওয়া নতুন গ্রাহকদের জন্য আমরা প্রিপেইড কার্ড ইস্যু করি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, এবছরের জুন পর্যন্ত মোট ৪২ লাখ ৬৯ হাজার প্রিপেইড কার্ড গ্রাহকদের দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে গত এক বছরে দেওয়া হয়েছে ২৪ লাখ। এ হিসাবে, নতুন প্রিপেইড কার্ড বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। এবং, সেইসঙ্গে ক্রেডিট কার্ডও বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের মতে, আগের চেয়ে ব্যাংকে অনেক কম ডলার আসছে।
তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আসার পর অনেক ব্যক্তি আগে আমাদের কাছে ডলার বিক্রি করতেন, বর্তমানে তারা এ ধরনের লেনদেন কমিয়েছেন। আরো দাম বাড়ার আশায়, তাদের বেশিরভাগই এখন ডলার ধরে রাখছেন। ফলে চাহিদা বাড়তে থাকলেও, ব্যাংকের কাছে ডলারের জোগান বাড়েনি। তাই ব্যাংকের পক্ষেও গ্রাহকের চাহিদামতো ডলার সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।’
মাত্র এক মাস আগেও খোলা মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ১১২ থেকে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে কেনা যেত। গত দুই সপ্তাহ ধরে এই বাজারেও দর বাড়ছে, মঙ্গলবার এক ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৮ থেকে ১২০ টাকায়।
গেল সপ্তাহে অন্তত ছয়টি মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ ঘুরে টিবিএসের প্রতিবেদক দেখেছেন, যারা ডলার বিক্রি করছে- তারা কেউই সরাসরি বর্তমান বিনিময় হারের কথা বলছে না। যদি কেউ বেশি দর দিতে রাজি থাকে, তাহলে বিকল্প জায়গা থেকে তাকে ডলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেছিল অধিকাংশ এক্সচেঞ্জ হাউজ।
গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকেলে টিবিএসের একজন প্রতিবেদক দিলকুশায় অবস্থানরত এক মানি চেঞ্জারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। ওই বিক্রেতা প্রথমে দাবি করেন, তার কাছে কোনো ডলার নেই। কিন্তু, প্রতিবেদক যখন পরে বলেন, খুব জরুরি কাজে তার নগদ ডলার দরকার, তখনই তিনি ১১৮ টাকা দর হাঁকেন। তবে এই লেনদেন তার অফিসের বাইরে অন্য কোথাও করার অনুরোধ করেন।
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হেলাল উদ্দিন সিকদার টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে অনেকটা উচ্চ দরেই ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে। ডলারের উচ্চ দাম নেওয়ার এ ঘটনা সর্বত্রই ঘটছে।
তবে মঙ্গলবার নগদ ডলারের দাম কমেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, নগদ ডলার সরবরাহের চেয়ে চাহিদার চাপ বেশি। মানি এক্সচেঞ্জে উচ্চ দরের এটাই কারণ।
‘কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের দাম ব্যাপকভাবে কমাতে বাধ্য করেন, তাহলে এ ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে পড়বে।’
হেলাল আরো দাবি করেন যে, ব্যাংকগুলো যে দরে বিক্রিতে সম্মতি দিয়েছে, কিছু কিছু ব্যাংক তার চেয়ে বেশি দামে নগদ ডলার বিক্রি করছে। ‘আমরা দেখেছি কোনো কোনো ব্যাংকের ওয়েবসাইটে যে দরে ডলার বিক্রির কথা বলা আছে, তার চেয়েও বেশি দামে তারা বিক্রি করছে। এখন ব্যাংকই যদি এভাবে বিক্রি করে, তাহলে অযথা আমাদের ওপর কেন চাপ দেওয়া হচ্ছে?’
তিনি আরো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ব্যাংকগুলো বলছে, আমদানির জন্য তারা সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা দরে বিক্রি করছে।
হেলালের মতে, ব্যাংকের তুলনায় খোলা মুদ্রাবাজারে বিনিময় হার কিছুটা বেশি থাকাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদেরকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে দেড় টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রির অনুমতি দিয়েছে।
ব্যাংকে নগদ ডলারের সংকট
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) গত বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, নগদ ডলার বিক্রি হয়েছে গড়ে ১১১ টাকায়, এবং সর্বোচ্চ দর ছিল ১১৩ টাকা। কিন্তু গ্রাহকদের মতে, ব্যাংকে ডলার পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
টিবিএস গত দুই সপ্তাহে অন্তত ছয়টি ব্যাঙ্কের সাথে যোগাযোগ করে; তাদের মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক বলেছে, তাদের কাছে নগদ ডলার নেই।
এর মধ্যে একটি ব্যাংক জানায়, তাদের কাছে নগদ ডলার আছে। তবে তারা বলে যে, বেশকিছু শর্তসাপেক্ষে তারা ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছে তা বিক্রি করছে।
ওই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের আমাদের মাধ্যমে টিউশন ফি পাঠাতে হয়, তাদের নগদ ডলারের প্রয়োজন হয়। আমরা সবসময় তাদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করি। এছাড়া কিছু গ্রাহক ব্যাংকের সাথে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেও নগদ ডলার পেয়ে থাকেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বেশ কয়েকটি অথরাইজড ডিলার (এডি) শাখা থাকলেও – তাদের সবার কাছে নগদ ডলার নেই। বর্তমানে ২ থেকে ৩টি শাখা নগদ ডলার বিক্রি করছে।
বাফেদা ও এবিবি কি তালগোল পাকিয়েছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে জানান, বিনিময় হার বাজার-ভিত্তিক হবে কর্তৃপক্ষ একথা বললেও – তা পুরোপুরি বাজার-ভিত্তিক হয়নি, বরং বাফেদা ও এবিবির মতো কিছু গোষ্ঠী তা নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিনিময় হার নির্ধারণে বাফেদা ও এবিবির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘বাফেদা ও এবিবি কারা? তাদের সিদ্ধান্ত কি বাজারের প্রতিফলন? মোটেও তা নয়।’
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির এই অধ্যাপক উত্তর কোরিয়ায় যেমন নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি দেখা যায় – তার সাথে (বাংলাদেশের) বাজারে প্রকৃত চালিকাশক্তির অভাবের সূক্ষ্ম উপমা দিয়েছেন।
এছাড়া, নীতি ঘোষণা ও তার প্রকৃত বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যাপক অমিল থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে, তিনি একে ‘পলিসি হিপোক্রেসি’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তার মতে, কর্তৃপক্ষ বাজার-ভিত্তিক পদ্ধতির ঘোষণা করলেও– প্রকৃতপক্ষে কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়ন করে না।
‘বাংলাদেশ ব্যাংক এর জন্য ভুগছে, আর এ ভোগান্তি চলতেই থাকবে। বাজারে যা ঘটছে, ঠিক সে অনুযায়ী বিনিময় হারে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। তারপরেও, আমলাতান্ত্রিক গতি ও জটিলতা না থাকায়– হুন্ডিতে কিছুটা লেনদেন থেকেই যাবে।’
অবৈধ মুদ্রাবাজারের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম কমাতে গত ৩০ আগষ্ট এক যৌথ অভিযান শুরু করে।
এদিনে অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার, ৩০ হাজার কানাডিয় ডলার ও ৩৮ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। আটক করা হয় হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত কয়েক জনকে।
একইদিন বিশেষ পরিদর্শন শেষে আটটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরো ১০ প্রতিষ্ঠানকে ডলার বাণিজ্যে অনিয়মের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্ধারিত দরের চেয়ে তারা বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, এমনকি নিয়মিত তথ্য প্রদানও করেনি।
এসব অনিয়ম অনুসন্ধানে, গত বৃহস্পতিবার মতিঝিলের আদমজী কোর্ট এলাকার পাঁচটি মানি চেঞ্জারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
কিন্তু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অভিযানে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে মানি চেঞ্জারগুলোর মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে।
গত রোববার মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে – আট মানি চেঞ্জার্সের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করার অনুরোধ করেন। এজন্য মানি চেঞ্জারদের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ডলার বাজারে এই যৌথ অভিযানের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক টিবিএসকে বলেন, বাজার কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। ‘তবে আমরা দেখেছি, বাজারে নগদ ডলার কেনা ও বেচা –দুইই কমেছে। বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় হয়তো লাগবে।’
মানি চেঞ্জারদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা অস্বাভাবিক দামে ডলার কেনাবেচা করছে। এজন্যই আমরা তাদের নজরদারির আওতায় এনেছি। তাদের স্বাভাবিক ব্যবসা যদি হয় কিছুটা বেশি দামে ডলার বিক্রি, তাহলে সেটা করতে পারে। কিন্তু, তাদের আইনের সীমার মধ্যে থেকে ব্যবসা করতে হবে।’
নগদ ডলারের চাহিদা বাড়ার পেছনে কারণ
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, ঈদ, পুজা, হজসহ বিভিন্ন উৎসব, কিংবা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার শুরুর সময়ে নগদ ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। ডলারের সাম্প্রতিক চাহিদা বাড়ার পেছনেও এগুলো প্রধান কারণ।
দ্বিতীয়ত, নিম্ন সুদহারের কারণে টাকা ব্যাংকে না রেখে– অনেকেই ডলারে সঞ্চয় করছেন। ডলারের ক্রমবর্ধমান দামও ভবিষ্যতে তাদের আরো লাভবান হওয়ার আশা দেখাচ্ছে। কিন্তু, এরফলে ব্যাংকখাতে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।