চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নয়নের জন্য অস্বাভাবিক রকমের বেশি বাজেটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রতি কিলোমিটারে ২৫৬ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নয়নের জন্য এই ব্যয় প্রস্তাব করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (আরএইচডি), যা একই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের বরাদ্দের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।
২৩.৫২ কিলোমিটার মহাসড়ককে শুধু চার লেন করার জন্যই এ ব্যয় ধরা হয়েছে। ফ্লাইওভার, সেতু নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণসহ সম্ভাব্য অন্যান্য ব্যয় এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব খাতের খরচ যোগ করলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা।
মহাসড়ক উন্নয়নের ব্যয় এত বেশি ধরার কারণ জানাতে গিয়ে আরএইচডির কর্মকর্তারা বলেন, জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা—জাইকা এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে।
ওই সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। আর সেখানে জাপানের মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে বলে জানান তারা।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘এই প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে গত সপ্তাহে [১ আগস্ট] পরিকল্পনা কমিশনে বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রকল্পের ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে।’
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, এ প্রকল্পের ব্যয়ের বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলার সময় আসেনি।
‘পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আলোচনা শেষ হলে প্রকল্পের ব্যয় বা কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় চূড়ান্ত হবে,’ বলেন তিনি।
জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পের বিস্তারিত ডিজাইন এখনও শেষ হয়নি। বিস্তারিত ডিজাইন তৈরি শেষে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রকল্পের ব্যয় পুনঃনির্ধারণ করবে। তবে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগে তারা প্রকল্প প্রস্তাবটি যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা যেহেতু কারিগরি বিষয়, যে ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ নই, এ কারণে এটা মূল্যায়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।’
আরএইচডির প্রস্তাব অনুযায়ী, এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ১৩৬.৫৪ কোটি টাকা। এতে জাপান ঋণ দেবে ৮ হাজার ৮৭২.৩৬ কোটি টাকা।
এ প্রকল্পের ৮০.৭৪৯ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এছাড়া একটি ফ্লাইওভার ও ১৩টি সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৮১.৯৭ কোটি টাকা।
কক্সবাজারের নির্মাণাধীণ মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে টেকসই যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, এ প্রকল্পের আওতায় পটিয়া, দোহাজারী, লোহাগড়া, চকরিয়ায় চার লেনের আউটার রোডও নির্মাণ করা হবে। কেরানীহাটে নির্মাণ করা হবে ফ্লাইওভার।
আরএইচডি কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের ওপর চাপ কমাতে সরকার কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আরও বেশ কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়নও চলছে।
কক্সবাজারের চকরিয়ায় মাতারবাড়ী থেকে জাতীয় মহাসড়ক এন১ (ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার) পর্যন্ত একটি সংযোগ সড়ক বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন।
তবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মধ্যে এন১ অংশটি এখনও দুই লেনের সড়ক; এছাড়া একাধিক স্থানে বাঁক ও বড় বাজার এলাকা রয়েছে। এর ফলে বিশাল যানজট তৈরি হয়। সড়কের এ অংশে দুর্ঘটনার হার অনেকটাই বেশি বলে জানান কর্মকর্তারা।
একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের উন্নয়ন বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগবে। মাতারবাড়ী বন্দর চালুর বিষয়টি বিবেচনা করে কিছু আশু হস্তক্ষেপ দরকার হবে। সড়কের পাঁচটি অংশে আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে। ওই অংশগুলোর সমস্যার সমাধান হলে যানজট সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে কিছু অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ রাখা হয়েছে। এছাড়া কিছু অঙ্গে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, পরামর্শক খাতে ৪৯৪.৩৬ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের পক্ষে পরামর্শক খাতের ব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেন, তুলনায় কারগরি দিক থেকে অনেক বেশি জটিল প্রকল্প কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
এছাড়া নিরাপত্তা প্রস্তাবিত প্রকল্পে সেবা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১১২ কোটি টাকা। তাছাড়া ভবন নির্মাণ (২১ কোটি), গাড়ি কেনাসহ (১.৩৫ কোটি টাকা) কিছু ‘অপ্রয়োজনীয়’ ব্যয় প্রস্তাবও করা হয়েছে।
মোট ৮.৭৫ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে আউটসোর্সিং ভাড়া নেওয়ার জন্য। এছাড়া কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ২ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
আরেক দুশ্চিন্তা অর্থছাড়ে বিলম্ব
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ২৯ মার্চ এ প্রকল্পের জন্য জাইকার সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে জাইকা এ প্রকল্পে ৪২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। চলতি অর্থবছর থেকেই ঋণের অর্থ ছাড় হওয়ার কথা রয়েছে।
কিন্ত প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে অর্থছাড়ও পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা।