হামাসের সামরিক সক্ষমতায় ইসরাইলে আতঙ্ক : গোয়েন্দারা কেন ব্যর্থ হলো

বাংলাদেশ ক্রনিক্যাল ডেস্ক :   ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস অনেকটা আকস্মিকভাবেই ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। শনিবার সকালের এই হামলা ইসরায়েলিদের পাশাপাশি অনেককে বিস্মিত করেছে। সাধারণত ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা হামলা চালিয়ে আসছিল হামাস। এবার হামাস কেন আগে হামলা চালাল, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। অপরদিকে বিশ্বখ্যাত ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা কেনই বা আগাম তথ্য জানতে পারলো না তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এতে হামাসের সক্ষমতা ও যুদ্ধের গোপনীয়তা রক্ষায় বড় সাফল্য হিসাবে দেখা হচ্ছে।
ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের সামরিক অভিযানে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত ইসরায়েলির সংখ্যা ৩০০ ছড়িয়েছে। আর ইসরায়েলি হামলায় কত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। যেভাবে গাজায় বড় ভবনগুলো উড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাতে মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফায় একের পর এক হতাহত ব্যক্তিকে আনা হচ্ছে। লোকজনকে রক্তদানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইসরাইল স্থল অভিযান শুরু করেছে। এর আগে তারা একজন ব্রিগেড কমান্ডার হারিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন গাজায় ইসরাইলের স্থল অভিযান চেচনিয়ায় গ্রোজনি যুদ্ধের রুপ নিতে পারে। যা রুশ বাহিনীর জন্য এক ভয়াল আতংকের বিষয় হয়ে উঠেছিলো। ইতোমধ্যে বহু ইসরাইলি সেনা ও সাধারন নাগরিককে আটক করেছে হামাস। প্রথমে হামাসের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিলো এই সংখ্যা ৫৭ জন। তবে ইসরাইল আটকের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে ধারনা করা হয় আটক ব্যক্তির সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় ইসরায়েলে হামাসের হামলা শুরু হয়। জবাবে গাজায় হামাসের বিভিন্ন অবস্থানে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। একই সঙ্গে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ডে ঢুকে পড়া হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই চলছে।
হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদোমি আল-জাজিরাকে বলেছেন, দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো নৃশংসতার জবাবে এই সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। খালেদ বলেন, ‘আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায়, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এবং আমাদের পবিত্র স্থাপনা আল-আকসায় ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধে উদ্যোগ নেবে। এগুলোই হামাসের এই অভিযানের কারণ।
মাত্র কয়েকদিন আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়হু জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যর একটি মানচিত্র দেখিয়েছিলেন। যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রাখা হয়নি। এই হামলার মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিলো ফিলিস্তিনিরা আছে। তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে কোনো মধ্যপ্রাচ্যে কোনো শান্তি আসবে না।
হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ বলেছেন, দুনিয়ার বুকে সর্বশেষ দখলদারত্বের অবসানে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের দিন আজ। তিনি বলেন, ‘যাঁর কাছেই একটি বন্দুক রয়েছে, তাঁর উচিত সেটা নিয়ে বের হওয়া। সময় এসে গেছে। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে পশ্চিম তীরের প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাশাপাশি আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে এই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
গাজায় হামাস সরকারের সাবেক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজি হামাদ আল-জাজিরাকে বলেন, যেসব আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে, এই অভিযান তাদের জন্যও একধরনের বার্তা।
গাজি হামাদ বলেন, আমি মনে করি, এটা তাদের জন্য লজ্জার। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আরব দেশগুলোর প্রতি আমি আহ্বান জানাই। কারণ, ইসরায়েল শান্তি ও সহ-অবস্থানে বিশ্বাস করে, এমন কোনো দেশ নয়। এটা শত্রুরাষ্ট্র; তাদের প্রতিহত করতে হবে।


সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুসলিমদের পবিত্র স্থাপনা আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ইহুদিদের অনুপ্রবেশের ঘটনা বেড়েছে। ফিলিস্তিনিরা এ ধরনের অনুপ্রবেশের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এ নিয়ে আল-আকসায় মুসল্লিদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী।
হামাসের পক্ষ থেকে আল-আকসার ‘স্থিতাবস্থায়’ কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টাকে ‘চূড়ান্তসীমা’ হিসেবে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এরপরও সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর পাহারায় ইহুদিদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল। হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ‘আল-আকসার মর্যাদা রক্ষায় আমরা এই যুদ্ধ শুরু করেছি।
হামাসের এই অভিযানের পর ইসরাইলে এখন আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর এত বড় আকারের আক্রমনের মুখোমুখি হতে হয়নি ইসরাইলিদের। ইসরাইলের মানুষ হয়ে পড়েছে আতংকগ্রস্ত। হাসপাতালে বহু লোক হার্টঅ্যাটাকে ভর্তি হয়েছেন। এখন বিশ্বজুড়ে একটাই প্রশ্ন ইসরাইলের সুসংগঠিত গোয়েন্দারা কেন এমন হামলার আগাম তথ্য জানতে পারলো না। কিভাবে হামাস স্থল, নৌ ও আকাশ পথে এমন হামলার পরিকল্পনা করতে সক্ষম হলো।
ইসরাইলের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, এটা কীভাবে ঘটল, আমরা ভাবতেও পারছি না। এত খ্যাতি, নিরাপত্তা ও নজরদারি সরঞ্জাম থাকার পরও ইসরায়েল কেন হামাসের হামলার বিষয়ে আগাম আঁচ করতে পারল না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
শনিবার স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ছয়টা। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে একের পর এক রকেট হামলা শুরু হয় ইসরায়েলে। সীমান্ত পার হয়ে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ডে ঢুকে পড়েন হামাস যোদ্ধারা। কিন্তু এমন হামলা হতে পারে, তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না ইসরায়েলি বাহিনীর।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, শিন বেত ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দাদের কেউই জানত না, হামাস এ ধরনের একটি হামলা করতে যাচ্ছে। ইসরায়েলিদের কাছে এটা খুবই অবাক করার মতো বিষয়। আবার হতে পারে, গোয়েন্দাদের কেউ কেউ হামলার বিষয়ে আগাম তথ্য পেলেও সেই অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো হামাসের যোদ্ধার ইসরাইলের অনেক ভেতরে ঢুকে সামরিক স্থাপনা দখল করে নিয়েছে। সেখান থেকে সেনা ও বেসামরিক ইসরাইলিদের আটক করে তাদের গাড়িতে করে গাজায় নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ করার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি ইসরাইলের সেনারা। অনেক ইসরাইলি সেনা ভয়ে আতœসমর্পন করেছে। এমন ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। হামাস খুব সহজে ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ নিয়ে যেতে পেরেছে। অন্তত ২০ টি স্থানে যুদ্ধ হলেও সে সর্ম্পকে কোনো তথ্য জানতে পারেনি ইসরাইলি গোয়েন্দারা।
বলা হয়ে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সক্রিয় ও চৌকস গোয়েন্দা সংস্থা হচ্ছে ইসরায়েলের। অঞ্চলটিতে গোয়েন্দাদের পেছনে ইসরায়েলের মতো এত বেশি অর্থ অন্য কোনো দেশ ব্যয় করে না। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী, লেবানন, সিরিয়া ছাড়াও অন্যত্র তাদের গুপ্তচর ও তথ্যদাতা আছে।
অতীতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা। এসব নেতা কখন কোথায় যেতেন, কোথায় থাকতেন, তার সব তথ্যই থাকত তাদের কাছে। সব তথ্য জেনে সুবিধামতো সময় ও জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলায় তাঁদের হত্যা করা হতো।


ইসরায়েলি গোয়েন্দা কখনো এসব গুপ্তহত্যা চালাত নির্দিষ্ট অবস্থান নিশানা করে ড্রোন হামলা চালিয়ে, কখনো নিশানা করা ব্যক্তির গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়ে তাকে শনাক্ত করে। এমনও হয়েছে, ফোনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বা বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে নিশানা করা ব্যক্তিকে খুন করা হয়েছে।
কিন্তু হামাসের এই হামলার মধ্যদিয়ে প্রমান হলে গাজায় ইসরাইলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য হামাস বিভিন্ন সময় ইসরাইলের সাথে যোগাযোগ রাখার অপরাধে বেশ কয়েকজন গাজার অধিবাসিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করতে হয়েছে হামাসকে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে অন্য অনেকের চেয়ে ভালো জানে ফিলিস্তিনি এই সংগঠন। ফলে এই হামলার বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্য নানাভাবে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিতে হয়েছে এবং তাদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হয়েছে। ইসরায়েলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামাসের এই হামলা নিয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের একটি তদন্ত । তবে এ তদন্ত শেষ করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

ছবি : আনাদুলু এজেন্সি