করোনা মহামারি চলাকালে বিশ্বব্যাপী জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যয় আকাশচুম্বী হয়েছিল। এ সুবিধা নিতে দেশের শিপিং লাইনগুলোও সমুদ্রগামী জাহাজের বহরে বিপুল বিনিয়োগ করে। কিন্তু, পুনরুদ্ধারকালে দেশের আমদানি কমার সাথে সাথে বৈশ্বিকভাবে ফ্রেইট চার্জ বা জাহাজ ভাড়া কমতে থাকায়– তারা এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
কেএসআর গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও কর্ণফুলী গ্রুপের মতো জাহাজ-মালিকানায় থাকা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাবে গত এক বছরেই বাল্ক ক্যারিয়ার এবং কনটেইনার শিপ- উভয় ধরনের জাহাজে ফ্রেইট চার্জ বৈশ্বিকভাবে কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি।
পাশাপাশি, ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে যাওয়ায়, কনটেইনার জাহাজে সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে। এতে পরিচালনা ব্যয় তুলে আনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। নতুন জাহাজ তৈরী কিংবা পুরোনো জাহজের দামও ঊর্ধ্বমুখী; এই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ হ্রাস করা হচ্ছে বলেও জানান তারা।
এপর্যন্ত নিবন্ধিত ৯৭টি জাহাজের মধ্যে, ৪৪টি-ই কেনা হয়েছে মহামারির তিন বছরে।
কিন্তু, তারপর ফ্রেইট চার্জ মহামারি-পূর্ব সময়ের চেয়েও নিচে নেমে যাওয়ায়– দ্রুত তাদের মুনাফা মার্জিনেও পতন হতে থাকে।
একই অবস্থা বৈশ্বিক শিপিং ব্যবসায়। করোনা মহামারিকালে এই খাতটি টানা সাত প্রান্তিক রেকর্ড আয় করলেও – ২০২৩ সালে লাভজনকতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক ও ক্রাউন ন্যাভিগেশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহেদ সারোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘মহামারির আগে ইউরোপে একটি কনটেইনার পাঠানোর ভাড়া গুনতে হতো ২,৫০০ ডলার, মহামারিকালে যা বেড়ে ১২,৫০০ ডলারে পৌঁছায়। কিন্তু, আমদানি হ্রাসের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পণ্য চাহিদা কমানোয়- বর্তমানে এই রুটে শিপিং লাইনভেদে ১,০০০-১,৫০০ ডলার ভাড়া দিতে হয়।’
জাহাজ শিল্পের বৈশ্বিক তথ্যমতে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির প্রথম ঢেউ দেখা দেওয়ার পরের শীর্ষ অবস্থান থেকে পতন হয়ে বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে জাহাজ ভাড়া। এরমধ্যে এ শিল্পের সক্ষমতা বাড়লেও, পণ্য পরিবহনের পরিমাণে পড়তি দশা। এক বছর আগে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের বন্দরে ৪০ ফুটের কনটেইনার বহনে জাহাজ ভাড়া ছিল ১৬ হাজার ডলার, বর্তমানে তা মাত্র ১ হাজার ডলারে নেমে এসেছে। উত্তর ইউরোপের বন্দরে কনটেইনার বহনে যেখানে ভাড়া দিতে হতো ১৪ হাজার ডলার, সেখানে এখন দিতে হয় ১,৪০০ ডলার।
স্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো জানায়, ফ্রেইট চার্জ কমতে থাকায় জাহাজ শিল্পের থাকায় শিপিং এজেন্ট, ফিডার জাহাজ ও মেইনলাইন জাহাজ পরিচালনাকারীরা অস্থিতিশীল এক অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সাল থেকে প্রায় জাতীয় পতাকাবাহী জাহাজের বহরে যুক্ত হয়েছে ৬৫টি জাহাজ। ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পাতাকাবাহী জাহাজে বিনিয়োগ এবং নিবন্ধন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও ২০২৩ সালে এসে কমে গেছে।
সমুদ্রগামী বাংলাদেশের পাতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ৯৭টি; এরমধ্যে ২০১৮ সালে ৯টি, ২০১৯ সালে ১৩টি, ২০২০ সালে ১৫টি, ২০২১ সালে ১২টি, ২০২২ সালে ১৭টি এবং ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ৮টি জাহাজের নিবন্ধন নেয় বিনিয়োগকারীরা।
মেরিটাইম সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন, ২০১৯ প্রণয়ন করে। এতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা, দেশের সমুদ্র বন্দরে জাহাজের বার্থিং পেতে অগ্রাধিকার, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্যের ৫০ শতাংশ দেশীয় জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাহাজ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জটিলতাও দূর করা হয়। আইনটি কার্যকর হবার পর বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী সমুদ্রগামী জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয়।
নতুন বিনিয়োগের আর সুযোগ নেই
দেশের সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি জাহাজ কেএসআরএম গ্রুপের। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছে ২৪টি জাহাজ। এসব জাহাজে প্রায় ৩৫৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তারা। কিন্তু, আগের বছরগুলো ভালো সংখ্যায় নিবন্ধন নিলেও, ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি মাত্র একটি জাহাজের নিবন্ধন নিয়েছে।
নতুন বিনিয়োগের এই পড়তি অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে কেএসআরএম এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম টিবিএসকে বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে পুরোনো জাহাজের দাম কমে গিয়েছিল। ফলে এই খাতে নতুন বিনিয়োগ বেশি হয়েছে। তবে পুরোনো জাহাজের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী।’
বাংলাদেশী পতাকাহী জাহাজের সংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মেঘনা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বহরে আছে ২২টি জাহাজ। এ খাতে তাদের বিনিয়োগ প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। তাদের বহরে থাকা ছোটবড় জাহাজ মিলিয়ে প্রতিটির গড় মূল্য ২৫ মিলিয়ন ডলার।
২০২৩ সালে এই শিল্পগ্রুপটি তিনটি নতুন জাহাজের নিবন্ধন নেয়।
২০২২ সালে মেঘনা গ্রুপ চারটি নতুন বাল্ক ক্যারিয়ার তৈরি করে। এরমধ্যে ‘মেঘনা ভিক্টরি’ নামক জাহাজের সক্ষমতা ৬৬ হাজার টন। এর দাম পড়েছে ৩৫ মিলিয়ন ডলার। চারটি জাহাজে গ্রুপের মোট বিনিয়োগ ছিল ১০৫ মিলিয়ন ডলার। নতুন চারটি জাহাজের মধ্যে তিনটির নিবন্ধন নেওয়া হয় ২০২৩ সালে।
মেঘনা ওশেন-গোয়িং ফ্লিটের মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) মোহাম্মদ আবু তাহের টিবিএসকে বলেন, এশীয় অঞ্চলে আগে বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজের দৈনিক ভাড়া ছিল ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলার। এখন সেটি নেমে এসেছে ১০ হাজার ডলারে। এছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা অঞ্চলে জাহাজের দৈনিক ভাড়া ৪০-৪৫ হাজার ডলার থেকে নেমে এসেছে ২০ হাজার ডলারে।
তিনি আরো বলেন, ‘ফ্রেইট চার্জ কমে যাওয়ার কারণে এই খাতে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। আমরা সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি দেখছি। মেঘনা গ্রুপের বহরে নতুন জাহাজ যুক্ত করার বিষয়ে আপাতত আমাদের পরিকল্পনা নেই।’
২০২০ সালে দুটি পুরোনো কনটেইনার জাহাজ কিনে এ খাতে ব্যবসা শুরু করে কর্ণফুলী গ্রুপ। বর্তমানে তাদের বহরে বাংলাদেশি পতাকাবাহী ফিডার জাহাজের সংখ্যা ৮টি। এগুলোর কনটেইনার পরিবহন সক্ষমতা ১,১০০ টিইইউ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১,৭০০ টিইইউ পর্যন্ত।
এসব জাহাজের মধ্যে দুটি ২০২০ সালে, চারটি ২০২১ সালে এবং দুটি ২০২২ সালে নিবন্ধন নেয় কোম্পানিটি। কিন্তু, এবছর কোনো নিবন্ধন নেয়নি। পুরোনো এসব জাহাজ কিনতে তারা ৫৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
কর্ণফুলী গ্রুপের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারে যেসব পুরোনো জাহাজ কেনা যেত, সেসব জাহাজের দাম এখন বেড়ে হয়েছে ১৭ মিলিয়ন ডলার। করোনার সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর কনটেইনার ভাড়া ছিল ৭৫০ থেকে ১,০০০ ডলার। এখন এই ভাড়া নেমে এসেছে ২৫০ থেকে ৩০০ ডলারে।’
‘দেড় হাজার টিইইউ সক্ষমতার জাহাজগুলো আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন করছে ৪০০ থেকে ৭০০ টিইইউ। অর্থাৎ, সক্ষমতার প্রায় অর্ধেক পণ্য পরিবহন করছে। কার্গো ভলিউম এবং ফ্রেইট চার্জ কমে যাওয়ার কারণে জাহাজগুলোর আয়ও কমে গেছে অর্ধেক। কোন কোন ট্রিপে লোকসানও গুনতে হচ্ছে’- বলছিলেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমান আইনে ৫০ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও, সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ‘এই আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে ট্রান্সশিপমেন্ট রুটে আমরা আরো অন্তুত ১০ টি জাহাজ আনতে পারব।’
বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ২০ বছর পুরোনো ৫০,০০০ – ৬০,০০০ ডেডওয়েট টনেজ (ডিডব্লিওটি) জাহাজ ক্রয় করে থাকে। করোনার সময় এসব জাহাজের দাম প্রায় অর্ধেক কমে গেলেও, এখন দাম আবার বেড়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ কেনায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি মূল্য গুনতে হচ্ছে বলেও জানান কর্ণফুলী গ্রুপের ওই কর্মকর্তা।
এখনও ব্যাপক সম্ভাবনার
পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিবছর ৯০০ মিলিয়ন ডলার জাহাজ ভাড়া বা ফ্রেইট চার্জ দেয় বাংলাদেশ। আগে এ মালবাহী বাণিজ্যের মাত্র ৮-১০ শতাংশ ধরতে পারত স্থানীয় সমুদ্রগামী জাহাজ, যা এখন ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এতে বার্ষিক ২০০ মিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ী ও নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকদের সমিতি (বিওজিএসওএ)-র চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের পর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হতে পারে এই সেক্টর। সরকার এই খাতে ট্যাক্স সুবিধা দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে এই খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। আরো বিনিয়োগের সম্ভবনা রয়েছে।’