১৩ মার্চ ২০২৩
নিজস্ব প্রতিনিধি
ভারতকে সব উজাড় করে দিলেও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে ব্যর্থ শেখ হাসিনার সরকার। বরং তিস্তার উজানে ভারতের দার্জিলিংয়ে আরো একটি পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে দেশটি। এতে তিস্তার পানি প্রবাহ আরো কমে যাবে। এমনিতেই ভারতের গজলডোবা ব্যারেজে পানি আটকে দেওয়ার ফলে শুকনো মওসুমে পানি প্রবাহ কমে তিস্তা শুকিয়ে নাব্যতা হারিয়ে যায়। নতুন করে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুকনা মওসুমে আরো কমে যাবে তিস্তার পানি।
সোমবার (১৩ই মার্চ) দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দার্জিলিংয়ে ৩টি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দার্জিলিংয়ে পরিকল্পিত ৩টি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে ২টির কারণে তিস্তার পানি প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ডিসেম্বর-এপ্রিল মাসে, যখন বাংলাদেশে সেচের জন্য পানির চাহিদা বেশি থাকে।
সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা লো ড্যাম প্রকল্প (টিএলডিপি) ১ ও ২ এর ওপর একটি বিশদ প্রকল্প প্রতিবেদন (ডিপিআর) তৈরির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। বড় রঙ্গিত নদীর ওপর পরিকল্পিত এই ২ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্মিলিত সক্ষমতা হবে ৭১ মেগাওয়াট। এ ছাড়া, বালাসন ও রংভাং নদীর ওপর বালাসন হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট (৩৮ মেগাওয়াট) ডিপিআরের জন্যও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
সূত্রটি টেলিগ্রাফকে বলেছে, ‘এ ছাড়া, আরও ১০টি ছোট পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডিপিআর তৈরির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে, প্রকল্পগুলো বাস্তব সম্মত কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, টিএলডিপি-১ ও ২ নিয়ে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ, বড় রঙ্গিত নদী বাংলাদেশে প্রবাহিত তিস্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের অধিকার আছে এবং তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তা স্থগিত হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্তি দিয়েছিলেন, তিস্তায় উভয় দেশের সেচের চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পানি নেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন যে, ‘তিস্তায় জল নেই’। তারপর তিনি বললেন, ‘সিকিম জল আটকে রেখেছে’। পানি তো আর এমনি আটকানো যায় না, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামেই পানি আটকে রাখা যায়।
তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে দেরি হওয়ায় ঢাকা কয়েক বছর ধরে বারবার দিল্লিকে সমস্যার কথা জানিয়েছে। কিন্তু, দিল্লি ও কলকাতার সম্পর্কের টানাপোড়নের কারণে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কিছু দিন আগে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় ২টি খাল খননে পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের পরিকল্পনা সামনে আসার পর ঢাকায় উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের একটি সূত্রের বরাতে টেলিগ্রাফ জানায়, চলতি বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ২ দেশের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক একটি সূত্র টেলিগ্রাফকে জানিয়েছে, সিকিমের ১১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে পরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঢাকার জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিকল্পিত পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ‘রান অব দ্য রিভার’ প্রকল্প বলা হচ্ছে। যার অর্থ, পানিবিদ্যুৎ তৈরির জন্য ব্যবহৃত পানি আবার নদীতে ফেরত দেওয়া হবে। তবে, একজন নদী বিশেষজ্ঞ টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে পানি ব্যবহার হলে সেচের জন্য আর পাওয়া যাবে না।
তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উর্বর পলির প্রবাহও কমে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিরাট এলাকার জমি উর্বরতা হারিয়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি সূত্র টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন, ‘আমরা তিস্তা ইস্যুটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখতে পারি না। কারণ এই পানির ওপর আমাদের দাবি ন্যায্য।’
তিস্তার উজানে কী হচ্ছে পুরো তথ্য বাংলাদেশের পাওয়া উচিত এবং ভারতের উচিত বাংলাদেশকে জানানো।
টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, ভারতের নদী বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত ব্যবহার করা হলে তিস্তা নদী মরে যেতে পারে। ভারতীয় সেচের চাহিদা মেটাতে পরিকল্পিত নতুন ২টি খাল খননের জন্য যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা অতিরঞ্জিত উল্লেখ করে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তিস্তার পানি এই অঞ্চলের বিদ্যমান সেচ চ্যানেলগুলোর সক্ষমতা পূরণে অপর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
একটি সূত্র টেলিগ্রাফকে জানিয়েছে, নদীর তলদেশে পলি স্থানান্তরে নদীর নীচে প্রচুর পানির প্রবাহ প্রয়োজন। পানির প্রবাহ জীববৈচিত্র্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সেচ ও বিদ্যুতের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করতে গিয়ে আমার প্রায়ই এ ২টি দিক ভুলে যাই। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনাকারীদের উত্তরাখণ্ডের জোশিমঠ শহরের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সেখানে ভূমি ধসে পড়েছিল এবং ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য অনেকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও এর টানেলকে দায়ী করেছেন।
একজন নদী বিশেষজ্ঞের বরাতে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, পূর্ব হিমালয়ের অস্থিতিশীলতা ও বৃষ্টিপাতের কথা ভুলে গেলে হবে না। আরও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থ আরও বন উজাড় করা এবং ব্লাস্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে টানেল তৈরি করা। আমি মনে করি, আমরা প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপের একটি সীমা আছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের পাওয়ার ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা বলছেন, তাপবিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমাতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আমাদের জানানো দরকার, এই যে তোমরা রান অব দ্য রিভার করছো, সেটা তো একটা মিথ্যাচার। এটা টেকনিক্যালি হয় না। রান অব দ্য রিভার হলে নদীতে পানি থাকে, অথচ তুমি বলছো তিস্তায় পানি নেই
বর্ষার পানির ক্ষতির দিকটা কমানো, শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়ানো আর বর্ষা পরবর্তী সময়ের সমস্যা সমাধান—সবগুলোই সম্ভব বড় জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে। এই কাজটি যৌথভাবে করা উচিত। এই লক্ষ্যে ২ দেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন এবং চুক্তি করেছেন।