- রিন্টু আনোয়ার
- ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৩৫
সাধারণ মানুষের মধ্যে কারো আইন-আদালতে ভীষণ ভয়, কারো শ্রদ্ধা। আর লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মধ্যে কাজ করে সর্বোচ্চ সতর্কতা। একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেলেই মহাবিপদ তাড়া করে তাদের। কিন্তু আইন-বিচারাঙ্গনে কর্মরতদের মধ্যে আইন-আদালত-বিচার নিয়ে শ্রদ্ধা-ভক্তি বা ভয় কি ওই পর্যায়ে? এ প্রশ্ন ওঠে কখনো কখনো। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনার কারণে সামনে আসে প্রশ্নটা। কিন্তু কখনো এর নিষ্পত্তি হয় না। কোনোমতে ঘটনার একটি অ্যাডহক সমাধা করে প্রশ্নটি ধামাচাপা দিয়ে ফেলা হয়। বহুদিন থেকে চলে আসছে এভাবেই। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবী আর বিচারকসহ আইনাঙ্গন সংশ্লিষ্টদের কদাকার ঘটনাকে জাস্ট ভাইবোনের বিরোধের মতো বিষয় বলে ঢেকে দেয়া হলো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই বিচারকের সাথে অসদাচরণের অভিযোগ ও আইনজীবীদের কর্মবিরতির কারণে আদালতপাড়ায় টানা কয়েক দিন যে অচলাবস্থা চলেছে একে কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বিচ্ছিন্ন বা আঞ্চলিক ঘটনা বলা যায় না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের জেলা জজসহ দুই বিচারকের অপসারণ ও নাজিরের শাস্তি দাবিতে আইনজীবীরা কর্মবিরতিসহ কি-না করেছেন? কীসব ভাষা ও আচরণ না করেছেন? এজলাস চলাকালে বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সাথে আইনজীবীদের আচরণ ও ভাষার নমুনা সামাজিক মাধ্যমে কয়েক মিনিটে সারা দেশের মানুষের দেখা হয়েছে। যে যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। একপর্যায়ে বিষয়টি গড়াল উচ্চ আদালতে। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীকে দেয়া হয় আদালত অবমাননার রুল। এরপর ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজিরা। দিনটিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বাংলাদেশের বিচারালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। আদালত বলেছেন, ওই বিচারকের সাথে আইনজীবীরা যে আচরণ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না। সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে।
কেবল উপরোক্ত তিনটি বাক্যের মধ্যে যে বেদনা ও শঙ্কার কথা বলা হয়েছে বিবেকবান যে কারো জন্য এতে ভাবনার অনেক উপাদান রয়েছে। আর একে ‘বাত কা বাত’ ‘কথা বা এমন কথা তো কতই শুনেছি’ মনে করলে সমস্যাই নেই। ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। সেখানকার এমপি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি আবার একজন আইনজীবীও। তার বাবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকও ছিলেন বাংলাদেশের আইন ও বিচারাঙ্গনের তারকা ব্যক্তিত্ব। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুই কথার বাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের গালিগালাজ এবং অশালীন আচরণকে ‘ভাইবোনের ঝগড়ার মতো’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আইনমন্ত্রী কোনো কিছু ঠিক করে দিলে আর কিছু লাগে না। কিন্তু কথার পিঠে কিছু কথা তো থেকে যায়। বিচারক-আইনজীবী-আদালত-বিচার তথা আইন কি ভাইবোনের বা মাছ-সবজি বাজারের কাইজ্জার বিষয়? উকিল-বিচারক গোলমাল থেমে গেছে। আইনজীবীরা এখন সেখানকার আদালতে যাচ্ছেন। আদালত চলছে। মানুষ মাত্রই টুকটাক গণ্ডগোলে তো জড়াতেই পারে। ডেক-ডেকচি একটু টুংটাং শব্দ তো হয়ই। হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান হয় না- এ ধরনের ‘জ্ঞানে’র কথা আমলে নিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তেমন কিছু হয়নি। হয়ে থাকলেও ল্যাঠা মিটে গেছে।
স্বামী-স্ত্রী ভাইবোন মিলে দল চালানো যায়। রাজনীতি বা দেশও চালানো যায়। ক‚টনীতিতেও এখন চালানো হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্কের কথা। তা বিচার বিভাগেও নিয়ে ঠেকালে আর বাকি থাকে কী? সাফাই গাওয়ার অন্তরালে এ আস্কারা একটি দেশের বিচার ব্যবস্থাকে কোন তলানিতে নিয়ে যেতে পারে- বিবেকবান যে কারো জন্য তা উদ্বেগের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ ফারুক আহমেদের সাথে অশালীন আচরণের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশও দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টরা এ অপসারণের কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু যারা সংরক্ষণ করে রেখেছেন তা কি সরানো যাবে? অথবা যেই লাখ-কোটি মানুষ ওই ভিডিওফুটেজ দেখেছেন, গালমন্দগুলো শুনেছেন, তাদের মনের হার্ডডিস্ক থেকে সরানো যাবে? বিচারকের সাথে অশালীন আচরণের ঘটনায় আদালত অবমাননার ব্যাখ্যার পরবর্তী তারিখ পড়েছে সামনের বিশ্বভালোবাসা দিবস ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। ওই দিন তিন আইনজীবী সশরীরে লিখিত ব্যাখ্যা দেবেন বলে ধার্য করা হয়েছে। যেখানে স্বয়ং আইনমন্ত্রী ‘ভাইবোন’ তত্ত্ব দিয়ে ফেলেছেন সেখানে ব্যাখ্যার ভাষা-বর্ণনা কী হবে বা হতে পারে তা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আছে এমন যেকোনো মানুষের জন্যই বোধগম্য। পাশাপাশি হাইকোর্ট কী রুলিং বা নির্দেশ দিতে পারেন, এ নিয়েও আলোচনা আছে। চলছে কিছু বিশ্লেষণও।
আদালত এ বিষয়ে রেফারেন্স পাবে কোথায়? বিশ্বের কোনো দেশে কোনো আদালত কক্ষে এ রকম ঘটনা ঘটেনি। না ঘটে থাকা মানে রেফারেন্সও নেই। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের আইন ও বিচারাঙ্গনের জন্য একটি মস্ত বোঝার মতো ঘটনাটি। তাদের নির্দেশনাই গোটা বিশ্বের দেশে দেশে রেফারেন্স হবে, যদি কোনো দেশের কোনো আদালত কক্ষে কোনো কালে এ ধরনের কাণ্ড কখনো ঘটে। সেই বিবেচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে! পারিপার্শ্বিকতা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বার সভাপতিকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আপনি শুধু আইনজীবী নন, আপনি আইনজীবীদের নেতা। মানুষ যখন বড় পদে যায়, তখন আরো বিনয়ী হয়। তার দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। এ সময় আদালতে পিনপতন নীরবতা থাকতে পারত। কিন্তু থাকেনি। বার সভাপতির পক্ষ নিয়ে তার আইনজীবী মোমতাজউদ্দিন বলে ওঠেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার সভাপতি নির্দোষ। তিনি আইনজীবী সমিতির সদস্যদের পক্ষে কথা বলেছেন। এটি বারের সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে এটি করেননি। এই দশায় সাধারণ মানুষই বা কী বার্তা পেল? আদালতের উষ্মার জবাবে আইনজীবীরা এমন আচরণ করলে সাধারণ মানুষ বিচারপ্রার্থীরা কী ভাবছেন? রাজনীতিকরা একে অন্যের সমালোচনা করতে গিয়ে পরস্পরের বহু কুকর্মের জানান দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় আইনজীবীরা একেবারে কম করেননি। হাইকোর্ট কেন কেবল আইনজীবীদের তলব করলেন, বিচারকদের প্রতি কেন আদালত অবমাননার রুল জারি করলেন না- এ নালিশ এনেছেন তারা। বিচারকদের আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ বলতেও ছাড়েননি তারা। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা উচ্চৈঃস্বরে বলেন, ‘ঠিক ঠিক’।
এত ঠিকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আইন-বিচার ও আদালত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারক বিচার চেয়েছেন। আগে অসদাচরণের শিকার বিচারকরাও বিচার চেয়েছিলেন। আদালতে তলব করে দুর্বিনীত আইনজীবীকে সমঝে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আদালতে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে তারা হাসিমুখে বের হয়ে বেপরোয়া আচরণের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন। ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর বা খুলনার ঘটনা অনেকের মনে আছে। যা আইন পেশার মানের নিম্ন গামিতার সাথে আরো নানান কিছু নির্দেশ করে। আইনজীবীদের অতিমাত্রায় রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার কুফলও বলছেন কেউ কেউ। আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত অন্যরাও এর বাইরে থাকছেন না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-টিআইবি একবার তাদের খানা জরিপ প্রতিবেদন দিয়ে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগ ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সার্ভিস সেক্টর’। সুপ্রিম কোর্ট এতে ক্ষুব্ধ হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি বলেছিল, এই জরিপ উপকারী নয়। টিআইবি বলেছিল, এটি দৃষ্টিভঙ্গিগত একটি বিষয়। তবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের মনোভাব কী, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক সময় অল্পসংখ্যক বিচারকের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
বড় দামি কথার প্রকাশ ঘটেছে বিচারপতির উপরোক্ত বক্তব্যে। আইনজীবী, বিচারক-বিচারপতি মিলিয়ে সংখ্যা গুনলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নি আদালত বা উচ্চ আদালতে আপত্তিকর ব্যক্তি ‘অল্পসংখ্যক’ই হবেন। তাদের দায় কেন নেবে গোটা বিচার বিভাগ, সরকার ও গোটা বাংলাদেশ? কিছু অভিযোগ-অনিয়মের পরও বিচার বিভাগ ডুবুডুবু নয়, নাক উঁচু করে না থাকলে আশার অবশিষ্ট ভরসাস্থল কোথায়? তাই হাইকোর্টের দেয়া শঙ্কা (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না, এ আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে) যেন অমূলক হয়, সেই আরাধনা কায়মনোবাক্যে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]