জাতিসত্তা বিনির্মাণে জিয়াউর রহমানের অবদান

জাতিসত্তা বিনির্মাণে জিয়াউর রহমানের অবদান

স্বাধিকার আন্দোলনের গর্ব ও অহংকার ধারণ করে আছে মার্চ মাস। এই মাসেই বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের লড়াই-সংগ্রাম সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। মার্চে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসন-কাঠামোর বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয় তার সূচনা-বিন্দুতে জড়িত ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তী নয় মাসে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশ নামক ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানের বিষয়ে বিশদ আলোচনার আগে স্বল্প পরিসরে হলেও তার ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি করাচি একাডেমি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচিতে ডি. জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দু’বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা-নিপীড়ন শুরু করে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের সংবাদ পেয়ে জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান। ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশারফ এর নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে গোটা জাতি আবার আতংকিত হয়ে পড়ে। পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করলে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী এবং জনতা একত্রে জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার পর এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে জিয়াউর রহমান আবারও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপিঠে আসীন করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৩ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর একটি নতুন যুগের সূচনা হয়।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের ওপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন।

একটি রাজনৈতিক দল যেখানে সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিল তখন জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে আসা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক স্বাধীনতার অন্যতম মূলস্তম্ভ বহুদলীয় গণতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়ে মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান এ কারণেই সবার থেকে আলাদা ছিলেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০ মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ—সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।

জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা দিয়ে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিকালে অসামান্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে দেশ গঠনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সততার মাপকাঠিতে তিনি আজও অনন্য ও অদ্বিতীয়। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েই দেশের চলমান অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেন। শক্ত হাতে চুরি, ডাকাতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসে।

Bangla outlook