২৭ জানুয়ারী ২০২৩
নিজস্ব প্রতিনিধি
আওয়ামী লীগের তৈরি করা সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে। তবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত চলমান সংসদ বহাল থাকার বিধানও রয়েছে। এমন একটি অবস্থায় চলমান গতিহীন আন্দোলন দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে, এনিয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে সংশয় তৈরি হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে উজ্জীবিত নেতা-কর্মীদের মাঝে হতাশা দেখা দিচ্ছে।
শেখ হাসিনা দীর্ঘ শাসনে অনেক নেতা-কর্মী প্রাণ দিয়েছেন। হাজারো বিরোধী নেতা-কর্মী কারাগারে আটক আছে। অনেকেই পুলিশের নিপীড়নে পঙ্গু হয়ে ঘরে বসেছেন।
চলমান এই আন্দোলনে বিএনপি’র দীর্ঘ দিনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এক রকম মাঠের বাইরে। দলটির আমীরকে গ্রেফতার করে কথিত জঙ্গি সহযোগিতার অভিযোগে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। প্রথমে দলটি যুগপৎ আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দিয়ে কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু আমীরের গ্রেফতারের পর দীর্ঘ দিনের সঙ্গী বিএনপি কোন বিবৃতি দেয়নি। এছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি গণমিছিল সব দলটিকে করতে দিয়েছে সরকার। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীকে মালিবাগে পুলিশ বাধা দিয়ে লাঠি চার্জ, টিয়ার শেল ও গুলি চালিয়েছে। এই নির্যাতনের বিষয়েও অন্যান্য দল গুলো থেকে কোন রকমের প্রতিবাদ বা বিবৃতি না দেওয়ায় দলটি অনেকটা হতাশ হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে যুগপৎ আন্দোলন কতটা সফল হবে তা নিয়েও ইতোমধ্যেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে জনমনে।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতে, চলমান কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন সম্ভব নয়। এমন অবস্থায় সরকার পতনের জন্য আগামী ঈদের পর থেকেই কঠোর আন্দোলন কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আসনের ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নুর আহমেদ মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরা আরও কঠোর কর্মসূচি চান। হাইকমান্ড যে কর্মসূচি দেবে তৃণমূল নেতাকর্মীরা সেই কর্মসূচি পালনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। এখন কবে নাগাদ কঠোর কর্মসূচি আসবে সেটা আমরা বলতে পারি না, এটা দলের সিদ্ধান্ত।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়া জেলার গাবতলি উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক নতুন বলেন, চলমান কর্মসূচি ঠিক আছে, ধাপে ধাপে আরও বেগবান হওয়া উচিত। আগামী ঈদের পর শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর শক্ত কর্মসূচি তৃণমূল নেতা-কর্মীরা প্রত্যাশা করেন।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শিকদার শহিদুল ইসলাম বলেন, সরকার পতনের জন্য আগামী ঈদের পর হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলা বিএনপির সদস্য মাসুদ করিম টিপু বলেন, চলমান কর্মসূচি নিয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে দুই ধরনের মত রয়েছে। যেসব নেতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেতাকর্মীরা কর্মসূচি পালন করছেন। অন্যদিকে দলের কতিপয় নেতা রয়েছেন যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই, বরং সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন, সেখানে কর্মসূচি পালন হচ্ছে না। কর্মসূচি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে।
তিনি বলেন, এখনই নয়, আরও ছয় মাস পর হার্ডলাইনে যাওয়া উচিত। তখন হরতাল-অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনে যেতে হবে এবং ওই কর্মসূচি ঢাকায় সফলভাবে পালন করতে হবে। সারাদেশে আন্দোলন কর্মসূচিতে যেসব নেতাকর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের পরিবারগুলো যেন মনে করে দল সবসময় তাদের পাশে আছে, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ধাপে ধাপে যে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে তা ঠিক আছে। তবে সরকার পতনের জন্য কর্মসূচি আরও বেগবান করতে হবে। সেক্ষেত্রে আগামী ঈদের পর হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করা উচিত বলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন।
ময়মনসিংহের পাগলা দক্ষিণ থানা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আখতারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করেন চলমান কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন সম্ভব নয়। তাই দলের হাইকমান্ড সঠিক সময়ে কঠোর কর্মসূচি দেবে। সেই কর্মসূচি পালন করতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রস্তুত।
যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, যে কর্মসূচি চলছে তাতে আমরা খুশি। তবে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি এখনই উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে না দিলে ভালো হয়, কারণ প্রশাসন আমাদের কর্মসূচি পালন করতে দেয় না। এ কারণে আরও পরে জুন-জুলাইয়ের দিকে থানা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি দিলে ভালো হয়। এই মুহূর্তে জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখা ভালো বলে আমার কাছে মনে হয়।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফজলে নকিব মাখন বলেন, চলমান কর্মসূচির মাধ্যমে যেটা বুঝি সেটা কর্মীদের নার্সিং করা হচ্ছে। তবে আরও কার্যকরী কর্মসূচি আসা উচিত, কিন্তু সেটা এখনই নয়। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক/দেড় মাস আগে থেকেই কঠোর আন্দোলনে যাওয়া উচিত।
রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মামুন বলেন, চলমান কর্মসূচিতে আমরা উজ্জীবিত। আগামী নভেম্বর থেকে সরকার পতনের জন্য লাগাতার কঠোর কর্মসূচি চাই। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারের পতন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেই কর্মসূচি পালনের জন্য প্রস্তুত।
পটুয়াখালী সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মাহবুব বলেন, নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ ও কৌশলী হয়ে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছি। আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচি দরকার। রোজার ঈদের পরে অথবা কোরবানির ঈদের পরে লাগাতার কর্মসূচি হওয়া উচিত। গণঅনশন, গণঅবস্থান, গণগ্রেফতার কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সাবেক সদস্য ইমতিয়াজ আহমেদ বকুল বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে আছি। সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কর্ণপাত করছে না। এরই মধ্যে তারা দুটি নির্বাচন করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সরকার যেন দুর্বলতা না ভাবে সেই ধরনের কর্মসূচি চান তৃণমূল নেতাকর্মীরা। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ঈদের আগে-পরে হরতাল-অবরোধের মতো লাগাতার কঠোর কর্মসূচি চান তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
তৃণমূলের মতো বিএনপির শীর্ষ নেতারাও কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় সম্ভব হবে বলে মন করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কর্মসূচি চলমান। ভবিষ্যতে আরও কঠিন কর্মসূচি আসবে, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা অনেক হিসাব-নিকাশ করেই এগোচ্ছি। আন্দোলন কাকে বলে ও কত প্রকার তা সরকার অচিরেই দেখতে পাবে।
তৃণমূল নেতাদের মতে, বিএনপির সঙ্গে ছোট-ছোট নাম সর্বস্ব অনেক দল জোট বাঁধলেও এতে বড় কোনো সুবিধা আদায় করতে পারবে না বিএনপি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা বলেন, আন্দোলনে গতি ও সফলতা আনতে হলে অবশ্যই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নীতিগত ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে আওয়ামী লীগের নীল নকশার রাজনীতিতে বিএনপি দাবি আদায়ে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।