ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের পরিণতি

  • ডিলান সুলিভান, জ্যাসন হিকেল
  •  ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৫৮
ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের পরিণতি – ছবি : সংগৃহীত

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যের নস্টালজিক পুনরুত্থান দেখা দিয়েছে। যেমনটি নিয়াল ফার্গুসনের ঊসঢ়রৎব: Empire: How Britain Made the Modern World এবং ব্রুস গিলের The Last Imperialist-এর মতো অভিজাত শ্রেণীর বইগুলো দাবি করেছে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভারত এবং অন্যান্য উপনিবেশে সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটিয়েছে। দুই বছর আগে এক জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটেনের ৩২ শতাংশ মানুষ সক্রিয়ভাবে দেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে গর্বিত।

ঔপনিবেশিকতার এই উজ্জ্বল ছবি ঐতিহাসিক রেকর্ডের সাথে নাটকীয়ভাবে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ রবার্ট সি অ্যালেনের গবেষণামতে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতে ১৮১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৩ শতাংশ। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি চরমভাবে ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে প্রকৃত শ্রমমজুরি হ্রাস পেয়েছিল। উনিশ শতকে দুর্ভিক্ষ যখন আরো ঘন ঘন ও মারাত্মক হয়ে ওঠে, তখন এটি একেবারে নিম্নস্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। ভারতীয় জনগণের উপকার করা থেকে দূরে অবস্থানরত ঔপনিবেশিকতা একটি মানবিক ট্র্যাজেডি ছিল, ইতিহাসের পাতায় যার বহু তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা একমত, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যিক শক্তির উৎকর্ষকাল ১৮৮০ থেকে ১৯২০ সময়টা ভারতের জন্য বিশেষভাবে ধ্বংসাত্মক ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা সম্পাদিত ১৮৮০-এর দশকে শুরু হওয়া ব্যাপক জনসংখ্যা শুমারি থেকে জানা যায়, সাম্রাজ্যিক শক্তির উৎকর্ষকালে এ অঞ্চলে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৮০-এর দশকে প্রতি এক হাজার জনে ৩৭.২ জন মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়ে ১৯১০-এর দশকে গিয়ে দাঁড়ায় ৪৪.২-এ। আর গড় আয়ুষ্কাল ২৬.৭ বছর থেকে নেমে দাঁড়ায় ২১.৯ বছরে। ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে সা¤প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে আমরা নৃশংস এই চার দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে নিহত মানুষের সংখ্যা অনুমান করতে আদম শুমারির তথ্য ব্যবহার করেছি। ভারতের মৃত্যুহার নিয়ে জোরালো তথ্য শুধু ১৮৮০-এর দশক থেকে বিদ্যমান। যদি আমরা এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যুর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করি, তবে আমরা দেখতে পাই, ১৮৯১ থেকে ১৯২০ সময়কালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ৫০ মিলিয়ন মৃত্যু একটি বিস্ময়কর পরিসংখ্যান। তবে এটি একটি পরিমিত অনুমান।

প্রকৃত মজুরির তথ্য ইঙ্গিত করে, ১৮৮০ সালের মধ্যে ঔপনিবেশিক ভারতে জীবনযাত্রার মান ইতোমধ্যে তাদের আগের স্তর থেকে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। অ্যালেন ও অন্যান্য পণ্ডিত যুক্তি দেন, ঔপনিবেশিকতার আগে ভারতীয় জীবনযাত্রার মান সম্ভবত পশ্চিম ইউরোপের উন্নয়নশীল অংশগুলোর সমতুল্য ছিল। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না, ভারতের প্রাক-ঔপনিবেশিক মৃত্যুর হার কত ছিল। তবে আমরা যদি ধরে নিই, এটি ১৬ এবং ১৭ শতকে ইংল্যান্ডের মতো ছিল, অর্থাৎ মৃত্যুহার প্রতি এক হাজার জনে ২৭.১৮, তাহলে আমরা দেখতে পাই ১৮৮১ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ভারতে ১৬৫ মিলিয়ন অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে।

যদিও অনুমান করে মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট সংখ্যাকে মৃত্যুহারের ভিত্তি নির্ণয় করাটা বেশ স্পর্শকাতর বিষয়, তারপরও এটি স্পষ্ট, ঔপনিবেশিকতার কোথাও কোথাও ১০০ মিলিয়ন মানুষের বেশ অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। এটি মানবেতিহাসে সবচেয়ে বড় নীতিজনিত মৃত্যু সঙ্কট। এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন, মাওবাদী চীন, উত্তর কোরিয়া, পলপটের কম্বোডিয়া এবং মেঙ্গিস্তুর ইথিওপিয়াতে যাবতীয় দুর্ভিক্ষের সময় সংঘটিত মৃত্যুর সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বড়।

ব্রিটিশ সরকার কিভাবে এই অভ‚তপূর্ব জীবনহানি ঘটাল? এর পেছনে বেশ কিছু কার্যসাধন-পদ্ধতি ছিল। প্রথমত ব্রিটেন কার্যকরভাবে ভারতের উৎপাদন খাতকে ধ্বংস করে দেয়। ঔপনিবেশিকতার আগে ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প উৎপাদনকারী ছিল। তারা বিশ্বের সব প্রান্তে উচ্চমানের টেক্সটাইল রফতানি করত। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত টোডরি কাপড় সহজে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি। অবশ্য ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এটি পরিবর্তন হতে শুরু করে।

ইতিহাসবিদ মধুশ্রী মুখার্জীর মতে, ঔপনিবেশিক শাসন কার্যত ব্রিটিশদের জন্য ভারতীয় শুল্ক প্রত্যাহার করেছিল এবং ব্রিটিশ পণ্যগুলোকে অভ্যন্তরীণ বাজারে অবাধে সয়লাব করার অনুমতি দিয়েছিল। পক্ষান্তরে ভারতীয়দের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স ও অভ্যন্তরীণ শুল্কের এমন একটি ব্যবস্থা চালু করে, যা ভারতীয়দের নিজেদের দেশের মধ্যে কাপড় বিক্রি করতে বাধা দেয়। তারা এটি রফতানি করা ছেড়ে দেয়। এই অসম বাণিজ্য ব্যবস্থা ভারতীয় উৎপাদনকারীদের পিষে ফেলে এবং কার্যত দেশটিকে শিল্পমুক্ত করে ফেলে। ১৮৪০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যান্ড চায়না অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ইংলিশ পার্লামেন্টে গর্ব করে বলেছিলেন, ‘এই কোম্পানিটি ভারতকে একটি উৎপাদনকারী দেশ থেকে কাঁচা পণ্য রফতানিকারী দেশে রূপান্তর করতে সফল হয়েছে।’ ভারতকে যখন দারিদ্র্যসীমার মধ্যে টেনে নেয়া হয়েছিল এবং জনগণকে ক্ষুধা ও রোগের শিকার করে তোলা হয়েছিল, তখন ইংরেজ উৎপাদনকারীরা একটি অসাধারণ সুবিধা লাভ করেছিল।

বিষয়টিকে আরো খারাপ করার জন্য, ব্রিটিশ উপনিবেশকারীরা আইনি লুণ্ঠনের একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। যা সমসাময়িকদের কাছে ‘ড্রেন অব ওয়েলথ’ বা ‘সম্পদের নিষ্কাশন’ হিসেবে পরিচিত (ভারতের সম্পদকে ইংল্যান্ডে স্থানান্তরকে ড্রেন অব ওয়েলথ বলা হয়। এর অর্থ হিসেবে সম্পদের নিষ্কাশনের পরিবর্তে মূলত পড়া উচিত সম্পদের লুটপাট-অনুবাদক)। ব্রিটেন ভারতীয় জনগণের ওপর করারোপ করে। অতঃপর ভারতীয় পণ্য নীল, শস্য, তুলা ও আফিম কিনতে সেই রাজস্ব ব্যবহার করে। এভাবে তারা এই ভারতীয় পণ্যগুলো বলা যায় বিনামূল্যে সংগ্রহ করে। এই পণ্যগুলো তখন হয়, ব্রিটেনে ব্যবহার করা হতো, অথবা ব্রিটিশ রাজ্যের পকেটের রাজস্ব দিয়ে পুনরায় বিদেশে রফতানি করা হতো। ব্রিটেন ও এর বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার শিল্প উন্নয়ন ও বিকাশে অর্থায়নের জন্য সেটি ব্যবহৃত হতো।

এই ব্যবস্থাটি বর্তমান বাজারমূল্যে ভারত থেকে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য নিষ্কাশন করেছে। ব্রিটিশরা ‘ড্রেন’ (পণ্য নিষ্কাশন)-এর ক্ষেত্রে নির্দয় ছিল। খরা বা বন্যা স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেললেও তারা ভারতকে খাদ্য রফতানি করতে বাধ্য করেছিল। ইতিহাসবিদরা প্রমাণ করেছেন, উনিশ শতকের শেষের দিকে কয়েকটি নীতিজনিত দুর্ভিক্ষের সময় লাখ লাখ ভারতীয় অনাহারে মারা গিয়েছিল। কারণ তাদের সম্পদ ব্রিটেন ও তার বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশগুলোতে চলে গিয়েছিল।

ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা তাদের নীতির পরিণতি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তারা লাখ লাখ মানুষকে না খেয়ে মরতে দেখেছেন, তবুও তারা তাদের নীতির পথ পরিবর্তন করেননি। তারা জেনেশুনে মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে গেছেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের শেষের দিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুহার কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। ইতিহাসবিদ মাইক ডেভিস যুক্তি দিয়ে বলেন, ব্রিটেনের সাম্র্রাজ্যবাদী নীতিগুলো অনেকটা ১৮ হাজার ফুট ওপর থেকে ফেলা বোমার নৈতিক সমতুল্য।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেনের শোষণমূলক নীতিগুলো ১৮৮১-১৯২০ সময়কালে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি অতিরিক্ত মৃত্যুর সাথে যুক্ত ছিল। আন্তজার্তিক আইনে সুদৃঢ় নিদর্শনসহ ক্ষতিপূরণের জন্য এটি একটি সোজাসাপ্টা সরল মামলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকারদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ চুক্তিতে জার্মানি স্বাক্ষর করে এবং সম্প্রতি নামিবিয়াকে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সেখানে ঔপনিবেশিক অপরাধের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়। বর্ণবৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ আফ্রিকা শ্বেতাঙ্গ-সংখ্যালঘু সরকার কর্তৃক সন্ত্রাসের শিকার লোকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

ইতিহাস বদলানো যায় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপরাধও মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু ক্ষতিপূরণ ঔপনিবেশিকতাসৃষ্ট বঞ্চনা ও বৈষম্যের উত্তরাধিকার দূর করতে সাহায্য করতে পারে। এটি ন্যায়বিচার ও নিরাময়ের প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।

আল-জাজিরার সৌজন্যে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]

* ডিলান সুলিভান : ফেলো, দ্য স্কুল অব সায়েন্সেস, ম্যাকুয়েরি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
* জ্যাসন হিকেল : প্রফেসর, দ্য ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, স্পেন