BBC News
বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তাপ, অর্থনীতিতে সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্ঘটনা আর অবকাঠামো খাতে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক সৃষ্টির মতো বেশ কিছু আলোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে দুই হাজার বাইশ সাল। এ বছর যে ঘটনাগুলো বাংলাদেশে বিপুল জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে এমন ৫টি আলোচিত ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করেছে বিবিসি।
পদ্মাসেতু:
২০২২ সালে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো পদ্মাসেতুর উদ্বোধন। বহুল আলোচিত এ সেতু চালু করা বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভোগান্তি দূর হয়েছে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ সেতুর দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রভাব রয়েছে বলেই মনে করা হয়। অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন এ সেতুর আর্থসামাজিক প্রভাব হবে সূদুরপ্রসারী।
“পদ্মাসেতুর অবস্থান এমন এক জায়গায় যা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে মধ্য অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর একটা সুন্দর সংযোগ করে দিচ্ছে। এবং পদ্মাসেতুর মাধ্যমে যেহেতু এখন খুব দ্রুততার সাথে চলে যাওয়া যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে, এর প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক হবে অর্থনীতিতে। আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করছি যে একদিকে মানুষে মানুষে সংযোগ হচ্ছে অর্থনীতির সংযোগ হচ্ছে এমনকি এই রিজিওনাল যে আমাদের ইন্টিগ্রেশন অন্যদেশের সাথে বাংলাদেশের সেখানেও কিন্তু এর একটা কৌশলগত ভূমিকা আছে।”
সিলেটের বন্যা:
২০২২ সালে আলোচিত একটি দুর্যোগ হলো সিলেট অঞ্চলের বন্যা। এ বছরে উজান থেকে আসা পানি আর টানা বৃষ্টিতে ব্যাপক বন্যার কবলে পড়ে সিলেট অঞ্চল। বন্যায় মারাত্মক ক্ষতি হয় ফসলের, বহু মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার সাথে যোগাযোগের মুল সড়ক ও রেললাইন পানিতে ডুবে যায়। এমনকি সিলেট ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেলস্টেশন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
সিলেট-সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা বন্যায় তলিয়ে যায়। স্থানীয় জনসাধারণ এত বড় বন্যার শিকার হননি বহু বছর। স্থানীয়দের কথায় ২০২২ সালের বন্যা পাল্টে যায় এ জনপদের জীবনযাত্রা। সিলেট সুনামগঞ্জ এলাকার মানুষেরা বলেন, এরকম বন্যা তাদের অনেকেরই জীবদ্দশায় দেখেননি সিলেট অঞ্চলের মানুষ। সুনামগঞ্জের পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী একজন কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন,
“অস্টাশির বন্যার পর আমার বয়সে এই পানি আমি দেখিনাই। অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। আমন ফসল এবার কেউ ঘরে তুলতে পারেনি। ঘর-বাড়ি, ফসল, মাছের খামারের ব্যাপক ক্ষতি করেছে ২০২২ সালের বন্যা”।
ডলার সংকট ও মূল্যম্ফিতি:
অর্থনৈতিক দিক থেকে ২০২২ সাল বাংলাদেশে আলোচিত একটি বছর। এ বছর ডলার সংকট ও রিজার্ভ কমার বিষয় বারবারই আলোচনায় এসেছে। আইএমএফ এর কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণের আবেদন করতে হয়েছে সরকারকে। কোভিড পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধার শুরুর পথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
২০২২ সারে সবধরনের পণ্য ও সেবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। মূল্যস্ফিতির গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
সাধারণ মানুষকে সবচে ভুগিয়েছে মূল্যস্ফিতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে নভেম্বরে এসে গড় মূল্যস্ফিতি দাড়ায় ৮. ৮৫ শতাংশে। কেন এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে একাধিক কারণ তুলে ধরেন বিশ্লেষকরা। অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলনে, “কোভিড পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা একত্রে আসায় সেটা মূল্যের ওপর একটা প্রভাব রেখেছে। আবার একই সময়ে যেহেতু ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলো সেই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে সেটাও আমাদের মূল্যস্ফিতিতে প্রভাব রেখেছে। এছাড়া ডলারের যে মূল্য বেড়েছে সেটার কারণেও কিন্তু অনেক খরচ বেড়েছে আমদানি পণ্যে। সুতরাং সেটাও কিন্তু মূল্যস্ফিতিতে প্রভাব রাখছে।”
বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কারসাজিও মূল্যস্ফিতির পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা।
“পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিন্তু মূল্যস্ফিতিটাকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। যতটা হওয়ার কথা ছিল তার থেকে আমরা বেশি দেখেছি।”
বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকট:
২০২২ সালে এক পর্যায়ে তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। এলএনজি আমদানি কমে যায়, রেকর্ড হারে বাড়ে তেলেরদাম। জ্বালানি সংকটে পড়ে বিদ্যুতের লোডশেড করতে হয়। এ বছর বিদ্যুৎ জালানি সংকটে ভুক্তভোগী হয় সারাদেশেরমানুষ।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতের সংকট ভুগিয়েছে সারাদেশের মানুষকে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে জ্বালানি সংকটকে দায়ী করে বিদ্যুৎ বিভাগ। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন,
“মূল কারণটাই হলো আমাদের প্রাথমিক জ্বালানির যে সংকট সেটা। সেটা প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তরলীকৃত জ্বালানি দুটোই এমনকি কয়লার ক্ষেত্রেও। জ্বালানি সংকট না হলে আমাদের যে সিস্টেম তাতে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন আমরা করতে পারতাম।”
জ্বালানি সংকটের পেছনে একটা বড় অবদান রেখেছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। অধ্যাপক সায়মা হক বলেন,
“হঠাৎ করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমরা দেখলাম যে চাপটা সবাই অনুভব করছে এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যারা আসলে জ্বালানির জন্য অন্য দেশের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল তারা অনুভব করছে।’
রাজনীতি:
রাজনৈতিক দিক থেকে ২০২২ সালটি ছিল বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। এ বছর বিএনপি সারাদেশে গণসমাবেশ করেরাজনীতির মাঠে সরব হয়। ডিসেম্বর মাসে দশ দফা দাবি এবং রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত রূপরেখা তুলে ধরে। এছাড়া বছরেরশেষে রাজপথে সরকার বিরোধী যুগপত আন্দোলনেরও সূচনা করে বিএনপি। বিএনপির দশ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশকে ঘিরে রাজনীতিতে ব্যাপক উত্তাপ সৃষ্টি হয়। বিএনপির নয়াপল্টন এলাকায় সমাবেশ করতে না দেয়ার ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থানে যায়। পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। ওই ঘটনায় বিএনপির মহাসচিবসহ বেশকয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং শত শত কর্মীকে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
অন্যদিকে বিএনপির রাজনীতি মোকাবেলায় আওয়ামী লীগও ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। সারাদেশে দলের সাংগঠিনক শক্তি বৃদ্ধি করতে তৎপর হয় ক্ষমতাসীনরা। দেশজুড়ে বড় বড় সভা সমাবেশ কর্মসূচী দিয়ে রাজপথে শক্ত অবস্থান এবং জনসমর্থন তুলে ধরে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনি বছর হিসেবে আগামী বছর হবে বিএনপির দাবি আদায়ে আন্দোলনের বছর। আওয়ামী লীগও চাইবে বিএনপিকে মোকাবেলা করে রাজপথ নিজেদের দখলে রাখার। সবমিলিয়ে ২০২৩ সালটি হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যেও ঘটনাবহুল একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর।